লেখক: এসএম রশিদ
অটোমান শাহজাদি দুরুশেহভার এলেন হায়দরাবাদের শেষ নিজাম ওসমান আলী খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র আজম জাহর স্ত্রী হয়ে। এ তুর্কি শাহজাদি ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদের একমাত্র কন্যা। তারই চাচাতো বোন শাহজাদি নিলুফার ছিলেন আজম জাহর ছোট ভাই মোয়াজ্জাম জাহর সঙ্গে। দুরুশেহভার ও নিলুফার দুজনই তাদের সৌন্দর্য, ফ্যাশন দিয়ে তখন রীতিমতো আইকন হয়ে উঠেছিলেন। লাস্ট নিজাম গ্রন্থের লেখক জন জুবরজিকি বলেছেন, দুরুশেহভার ছিলেন দৃঢ়চেতা, আভিজাত্যে পূর্ণ এবং স্মার্ট এক নারী।
১৯৩০-এর দশকে দুরুশেহভার ভারত ও পশ্চিমা দুনিয়ায় বেশ মনোযোগ পেয়েছিলেন। বলা হতো জব ও পান খাতি থি, তো হালাক সে যাতা হুয়া দিখতা থা—যখন তিনি পান খেতেন তখন সেটা তার গলা দিয়ে নামতে দেখা যেত—বলতেন তার এক বান্ধবীর দাদি। এমনই সুন্দরী ছিলেন এ শাহজাদি।
দুরুশেহভারের বয়স যখন ১০, তখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তার পরিবার তুরস্ক থেকে বিতাড়িত হয়। তাদের নতুন ঠিকানা হয় ফ্রান্সের নিস শহর। আজম জাহর সঙ্গে দুরুশেহভারের বিয়েতে অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। কারণ নিজেদের উত্তরসূরিদের জন্য তার হাত চেয়েছিলেন ইরানের শাহ ও মিসরের রাজা। অন্যদিকে তখন নিজামদের দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী পরিবার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও দুরুশেহভারদের পরিবার অর্থাৎ অটোমানরা সম্মান-মর্যাদায় নিজামদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
অটোমান শাহজাদি ও হায়দরাবাদের নিজাম পরিবারের মধ্যে এ বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল খেলাফত আন্দোলনের নেতা শওকত আলীর চিন্তাপ্রসূত। তিনি ওসমান আলী খানকে রাজি করিয়েছিলেন যে এর মাধ্যমে ইসলামী দুনিয়ার দুটো প্রভাবশালী পরিবার একত্র হবে। দুরুশেহভার ও নিলুফারের বিয়ে হয়েছিল একসঙ্গেই, ফ্রান্সের নিস শহরেই। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তুরস্ক ও হায়দরাবাদের হাতে গোনা কয়েকজন অভিজাত। বিয়ে পড়িয়েছিলেন দুরুশেহভারের পিতা খোদ খলিফা। সেদিন নিজামের রাজ্যে সব দপ্তর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ বিয়ে হয়েছিল ১৯৩১ সালের ১২ নভেম্বর।
দুরুশেহভার হায়দরাবাদে হাজির হয়েছিলেন যথেষ্ট কৌতূহল নিয়ে। ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ সফিউল্লাহ মনে করেন, এ বিয়ে সব দিক থেকেই উপযুক্ত হয়নি। যেমন দুরুশেহভারের উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি আর তার স্বামী মোটে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির। তুর্কি কন্যা বেড়ে উঠেছিলেন কসমোপলিটন সংস্কৃতিতে, অন্যদিকে হায়দরাবাদের নারীরা তখনো পর্দায় ঘেরা। দুরুশেহভারের পরিবার ছিল মুসলিম জাহানের একেবারে প্রথম সারির একটি। অবশ্য তাদের অর্থকড়ি তখন আর তেমন কিছু ছিল না। দুরুশেহভার তার স্বামীর অনেক উপপত্নী থাকার বিষয়টি জানতেন, কিন্তু সেসব মেনে নিয়ে নিজের মর্যাদা বজায় রেখেই নিজামের দরবারে হাজির হন। দুজনের স্বভাবেও ছিল অনতিক্রম্য দূরত্ব—তুর্কি শাহজাদি ছিলেন স্বাধীনচেতা, দৃঢ়, অন্যদিকে আজম জাহ ছিলেন জুয়ায় আসক্ত এবং হালকা চালের মানুষ। তাই তাদের সংসার যে খুব সুখের ছিল তেমনটা মনে হয় না।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীতেও দুরুশেহভারের পক্ষে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। লেখক ফিলিপ মেসন দুরুশেহভারের বর্ণনায় লিখেছেন, ‘তিনি সবসময়ই অভিজাত, রাজকীয়। আমার মনে হয়, ভাগ্য সহায়ক হলে তিনি হতেন দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত রানী।’
স্যার ওয়াল্টার মকটন বলেছিলেন, ‘তিনি বিভিন্ন বিবেচনায় হায়দরাবাদের সবচেয়ে স্মরণীয় ব্যক্তি—উচ্চকিত নন, কিন্তু স্থির সংকল্পের একজন নারী। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানে তার ব্যক্তিত্বই অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করত।’
জন জুবরজিকি তার আলোচিত গ্রন্থ দ্য লাস্ট নিজামে বিধৃত করেছেন দুরুশেহভারের পুত্র মুকাররম জাহর জীবন। জন উল্লেখ করেছেন, সে সময়ের হায়দরাবাদের দারুণ রক্ষণশীল জীবনযাত্রায় মানিয়ে নিতে দুরুশেহভারের বেশ অসুবিধা হয়েছিল। তিনি কখনই পর্দার আড়ালে যাননি। এমন গুজবও উঠেছিল যে নিজামের জ্যেষ্ঠ পত্নী দুলহান পাশা দুরুশেহভারকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিক দুরুশেহভারের স্বামী আজম ও তার ভাই মোয়াজ্জামের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। দুরুশেহভার মনে করতেন, হায়দরাবাদ কখনো অটোমান সংস্কৃতির ধারেকাছে যেতে পারবে না এবং হায়দরাবাদের মানুষ ভাবত দুরুশেহভার তাদের তাচ্ছিল্য করতেন।
শ্বশুর নিজামের সঙ্গে দুরুশেহভারের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে নির্মিত। নিজাম তাকে আম্মা কিংবা নাগিনা (রত্ন) বলে সম্বোধন করতেন। পুত্রের লেখাপড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাও তিনি দুরুশেহভারকে দিয়েছিলেন। গর্বিত শ্বশুর নিজাম মাঝেমধ্যেই তার ছেলের চেয়ে দুরুশেহভারের উচ্চতা বেশি হওয়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতেন। তিনি তার বান্ধবী রানী কুমুদিনী দেবীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়তেন, গাড়ি চালাতেন ও টেনিস খেলতেন। নিজের সৌন্দর্য, আচার-ব্যবহার, ফ্যাশন দিয়ে তিনি হায়দরাবাদের সামাজিক জীবনে বেশ পরিবর্তন এনেছিলেন।
জুবরজিকি জানান, ‘তিনি ছিলেন অনমনীয়, সত্যিকার শাহজাদি। তিনি ইংরেজি, ফরাসি, তুর্কি ও উর্দু ভাষায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন। পুত্র মুকাররমের শিক্ষার বিষয়ে তিনি ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’ তার লেখা কিছু ফরাসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি তার পুত্রদ্বয় মুকাররম ও মুফাক্কাম জাহর ইউরোপীয় শিক্ষা ও তুর্কি স্ত্রী নিশ্চিত করেছিলেন। মুকাররম পড়েছিলেন বিখ্যাত ইটনে। দাদা মীর ওসমান আলী খানের পরামর্শে মুকাররমকেই নিজামতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করা হয়। মুকাররম ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অনারারি এইড ডি ক্যাম্প নিযুক্ত হয়েছিলেন।
দুরুশেহভার বাস করতেন বেল্লা ভিস্তা নামের একটি সুন্দর ইন্দো-ইউরোপীয় প্রাসাদে। তিনি একসময় ভারতের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের একজন হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান। এটা হয়েছিল লাইফ ম্যাগাজিনের আলোকচিত্রী সেসিল বিতো ও জ্যাক বার্নসের কল্যাণে। তিনি ও তার বোন নিলুফার স্টাইল আইকন হিসেবে দুনিয়াজুড়ে আলোচিত হতে শুরু করেন এবং সে কিংবদন্তি এখনো মুছে যায়নি।
দুরুশেহভার হায়দরাবাদের নানা ধরনের কাজের মাধ্যমে তার ছাপ রেখে গেছেন। শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থসেবার উন্নয়ন ছিল তার মনোযোগের কেন্দ্রে। তিনি মেয়েদের জন্য একটি জুনিয়র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া পুরানি হাভেলিতে চালু করেন জেনারেল ও চিলড্রেন’স হসপিটাল। এটি এখনো তার নামে পরিচালিত হয়। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে আজমল খান তিব্বিয়া কলেজ হসপিটালের উদ্বোধনও করেছিলেন তিনি।
জুবরজিকি উল্লেখ করেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হায়দরাবাদ রাজ্যে তিনি বিভিন্ন ধরনের সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। তিনি হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজকল্যাণমূলক উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।’
১৯৭০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তার সময় ভাগ করে নেন হায়দরাবাদ ও লন্ডনের মধ্যে। শোনা যায়, লন্ডনে তার ড্রাইভার হায়দরাবাদের ব্যাজ পরে থাকতেন।
দুরুশেহভারের সঙ্গে সফিউল্লাহর সাক্ষাৎ হয়েছিল হায়দরাবাদে নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে; আরেকবার দেখা হয় নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিকে। ২০১৪ সালে দুরুশেহভারের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সফিউল্লাহ একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। তিনি তাকে দুনিয়ার শেষ স্মরণীয় রাজকীয় চরিত্রদের অন্যতম বলে আখ্যা দেন। দুরুশেহভারকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত সফিউল্লাহর মন্তব্য, ‘তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল যখন তিনি নিজামের জাদুঘর উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। তিনি একই সঙ্গে আভিজাত্যে মোড়া, কিন্তু একেবারে বিনয়ী মানুষ। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূল না হলে হয়তো তিনি হতেন ইতিহাসের প্রথম নারী খলিফা!’ ট্র্যাজেডি হলো যখন দুরুশেহভার জন্মগ্রহণ করেন তখন তার বাবা ছিলেন মুসলিম জাহানের খলিফা, কিন্তু কিছুদিন পরই তাকে এ পদ ও দেশ ছাড়তে হয়। আবার তার বিয়ের কয়েক বছর পর হায়দরাবাদ তার প্রিন্সলি স্টেটের মর্যাদা হারিয়ে ভারতীয় যুক্তরাজ্যের একটি রাজ্যে পরিণত হয়। জীবনে তাই অনেকবারই তাকে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
এমনকি ভারতেও তিনি তার সময়কার অন্য রাজকীয় নারীদের মতো স্বীকৃতি পাননি, যেমনটা পেয়েছেন জয়পুরের রাজমাতা গায়ত্রী দেবী (যার ওপর প্রায় ৪০টি বই লেখা হয়েছে) কিংবা বরোদার সীতা দেবী। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, দুরুশেহভার কখনো মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেননি। ‘গায়ত্রী দেবী স্মৃতিকথা লিখেছিলেন আ প্রিন্সেস রিমেমবারস শিরোনামে, যা আজ বেশ বিখ্যাত। এ স্মৃতিকথা তার খ্যাতিকে স্থায় রূপ দিয়েছে, যদিও বইটি বেশ সিলেক্টিভ। দুরুশেহভারের চিঠি ও লেখাপত্র হারিয়ে গেছে এবং এ কারণে তার কিংবদন্তীয় অনেকটাই মুছে গেছে। হায়দরাবাদের মাটিতে পা রাখার পর থেকে নানা রকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলেও তিনি রাজ্যটির জন্য অনেক অবদান রেখেছেন এবং তার এসব অবদান স্মরণে রাখা প্রয়োজন।’
২০০৬ সালে ৯২ বছর বয়সে দুরুশেহভার লন্ডনে প্রয়াত হন।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।