৮ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা জিন্নাত আলী এই মুহূর্তে ভর্তি আছেন ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জিন্নাত আলীর বয়স ২২ বছর। ১০ বছর ধরেই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছেন তিনি। তাঁর বর্তমান উচ্চতা ছাড়িয়ে গেছে গিনেস বুকের রেকর্ডধারী সবচেয়ে লম্বা মানুষ তুরস্কের সুলতান কশেনের উচ্চতাকেও। সুলতান কশেনের উচ্চতা ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি, আর এখন পর্যন্ত তাঁকেই জীবিত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ব্যক্তি বলে ধরা হয়।
সেদিক দিয়ে জিন্নাত আলী অচিরেই গিনেস বুকে স্থান পেতে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু জিন্নাত আলী বা সুলতান কশেন—তাঁরা কি স্বাভাবিক মানুষ? উত্তর হলো, না। তাঁদের এই অস্বাভাবিক উচ্চতার পেছনে দায়ী মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থির একটি টিউমার। আর এই রোগকে চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় জাইগেনটিজম।
আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর কপালের পেছনে দুই চোখের ঠিক মাঝখানটাতে রয়েছে ছোট্ট মটরদানার সমান একটা গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড। এর নাম পিটুইটারি গ্ল্যান্ড। একে বলা হয় মাস্টার গ্ল্যান্ড। কারণ, দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনগুলো এই পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকেই আসে। এর সামনের অংশ থেকে তৈরি হয় গ্রোথ হরমোন, যা আমাদের শারীরিক বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রোথ হরমোনের প্রভাবেই একটি শিশু ধীরে ধীরে লম্বা হতে হতে পূর্ণাঙ্গ উচ্চতায় পৌঁছায়। কৈশোরে এই গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণ হঠাৎ বেড়ে যায় বলে এই সময়টাতেই ছেলেমেয়েরা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সে গিয়ে থেমে যায় নতুন করে বৃদ্ধি, কেননা তত দিনে আমাদের হাড়ের গ্রোথ প্লেট বন্ধ হয়ে যায়। তার মানে এরপর আমরা আর লম্বায় বাড়ি না, আর গ্রোথ হরমোনের কাজও যায় কমে। এখন কোনো কারণে পিটুইটারি যদি অস্বাভাবিক হারে এই গ্রোথ হরমোন তৈরি করতে থাকে, তবে সেই মানুষটি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ১৮ বছরের আগে যদি কারও পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার হয়, তবে এই ঘটনা ঘটে। এটাই ঘটেছে জিন্নাত আলী বা সুলতান কশেনের বেলায়।
জাইগেনটিজম বা দৈত্যাকৃতি মানুষ বিশ্বে খুব বেশি নেই। ইদানীং এই সমস্যা সময়মতো শনাক্ত করা যায়। তাই পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিয়ে রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়ে গেছে। তা না হলে কেবল অস্বাভাবিক আকৃতি নয়, নানা রকমের সমস্যা হতে পারে মানুষটির। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ ইত্যাদি বড় হয়ে যাওয়া, হাড় ও মেরদণ্ডের সমস্যা, অন্ত্রের ক্যানসারসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে থাকে। তার ওপর টিউমার বেশি বড় হয়ে গেলে চোখের পেছনে চাপ সৃষ্টি করে, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দিতে পারে। তাই অস্ত্রোপচারই জিন্নাত আলীর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধান। যতদূর শোনা যায়, চিকিৎসকেরা জিন্নাত আলীর পিটুইটারির টিউমার অপসারণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে সে সময় এ ধরনের অস্ত্রোপচার চালু হয়নি। সে সময় এই বৃদ্ধিকে থামানোর কোনো উপায় জানা ছিল না চিকিত্সকদের। তার উদাহরণ রবার্ট ওয়াডলো। এখন পর্যন্ত তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ব্যক্তি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত।
১৯১৮ সালে জন্ম নেওয়া রবার্ট ওয়াডলোর উচ্চতা মাত্র ৫ বছর বয়সে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি ছাড়িয়ে যায়। তারপর দ্রুত বাড়তে থাকেন তিনি। ভদ্রলোকের শেষ উচ্চতা নেওয়া হয় ১৯৪৪ সালে, তখন তাঁর উচ্চতা ছিল ৮ ফুট ১১ ইঞ্চিরও ওপরে। জীবিত অবস্থায় রবার্ট রীতিমতো সেলিব্রিটিতে পরিণত হন তাঁর এই উচ্চতার কারণে। গিনেস বুকে তাঁর নাম ওঠে। বিখ্যাত ইন্টারকো কোম্পানি তাঁকে আন্তর্জাতিক সফরে নিয়ে যেতে থাকে। এই কোম্পানি তাঁকে বিনা মূল্যে জুতা তৈরি করে দিত। রবার্টের জুতার মাপ ছিল ৩৭! তার পা ছিল সাড়ে ১৮ ইঞ্চি লম্বা। অস্বাভাবিক উচ্চতার জন্য হাঁটতে সমস্যা হতো রবার্টের, তাই তিনি পায়ে ব্রেস ব্যবহার করতেন।
এই ব্রেস থেকেই একটা ছোট্ট ফোসকা আর সংক্রমণ হয় তাঁর পায়ে। এই সংক্রমণ থেকে মাত্র ২২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষটি। পরে পিটুইটারি শল্যচিকিত্সায় বিরাট উন্নতির কারণে এত বেশি লম্বা হওয়ার আগেই চিকিত্সা করা সম্ভব হয়েছে জাইগেনটিজমের রোগীদের। তারপরও তুরস্কের ৩১ বছর বয়স্ক সুলতান কশেন অস্ত্রোপচারের আগেই ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা হয়ে যান। অস্ত্রোপচার করে টিউমার ফেলে দেওয়ার পর তাঁর বৃদ্ধি এখন থামানো গেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের কক্সবাজারের জিন্নাত আলী ছাড়িয়ে গেছেন সুলতান কশেনকেও।
ইতিহাসে ও পুরাণেও দৈত্যাকৃতির বা জায়ান্ট মানুষের উল্লেখ মেলে। পবিত্র বাইবেলে গোলিয়াথ নামের একজন দৈত্যাকৃতির মানুষের উল্লেখ আছে, তাঁকে ডেভিড যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। গ্রিক পুরাণে জায়ান্ট অব ক্রিক বা টাইটানদের কথা বলা আছে। এ ছাড়া বিশ্বাস করা হতো যে রোডস দ্বীপে সব জায়ান্ট বাস করত, সেখানে বিশালকায় হেলিওস দেবতার ভাস্কর্যও রয়েছে। একসময় জাইগেনিটজমের রোগীরা সার্কাস ও সিনেমায় দর্শকদের বিনোদন দিতেন। জেমস বন্ডের বিখ্যাত দুটি সিনেমা মুনরেকার ও দ্য স্পাই হু লাভড মিতে এ রকম একজনের দেখা পেয়েছি আমরা। বিপুল জনপ্রিয় এই অভিনেতার নাম রিচার্ড কেইল। জেমস বন্ড ছবি ছাড়াও আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন এই জায়ান্ট।
ব্রিটেনের সবচেয়ে লম্বা ব্যক্তি (৭ ফুট ৭ ইঞ্চি) নেইল ফিঙ্গলেটন অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় ‘গেম অব থ্রোনস’ সিরিজে ম্যাগ দ্য মাইটি চরিত্রে। গত বছর মাত্র ৩৩ বছর বযসে মারা গেছেন নেইল। জায়ান্ট বা জাইগেনটিজমের রোগীরা বিখ্যাত ও জনপ্রিয় হলেও তাঁদের বেঁচে থাকাটা কিন্তু বেশ কষ্টের। অল্প বয়সেই তাঁরা হৃদ্রোগ, অস্থি ও সন্ধির নানা সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। চলাফেরা, যানবাহন ব্যবহার ইত্যাদিতে বেশ ঝামেলা হয় তাঁদের। বর্তমানে পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার অপসারণের সফল চিকিত্সা বাংলাদেশেও আকসার হচ্ছে। আশা করি অস্ত্রোপচার করে টিউমার ফেলে দিলে জিন্নাত আলী বাকি জীবনটা স্বাভাবিকভাবে কাটাতে পারবেন। তবে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা জীবিত ব্যক্তি হিসেবে গিনেস বুকে তাঁর নাম ওঠা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলে, ঢাকা
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।