ঘরের আগুনে পুড়ছে বরিশাল বিএনপি। সাবেক এমপি বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারীদের কোণঠাসা করতে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এ পরিস্থিতির। বরিশালে দলের বেশ বড় একটা অংশ এখনো সরোয়ারের অনুসারী। তাদের বাদ দিয়ে দল চালানোর চেষ্টা করছেন বর্তমান নেতারা। এতে দলে দেখা দিয়েছে স্পষ্ট বিভক্তি। সদ্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী। কেন্দ্রে দফায় দফায় অভিযোগ দিচ্ছেন তারা।

লন্ডনে অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর দেওয়া হচ্ছে এসব অভিযোগ। এরমধ্যে দুটি অভিযোগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে লিখিতভাবে বলেছেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়নেরও অভিযোগ উঠেছে বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে। দলীয় কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ না জানানোর পাশাপাশি যথাযথ সম্মান দেওয়া হচ্ছে না তাদের। বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারা।

৩০ বছরের বেশি সময় বরিশাল বিএনপিতে একক অধিপত্য ছিল মজিবর রহমান সরোয়ারের। এ সময় পাঁচবার সংসদ-সদস্য হওয়া ছাড়াও মেয়র ও হুইপ ছিলেন তিনি। গত বছর ৩ নভেম্বর অবসান ঘটে এ সাম্রাজ্যের। কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব পদে রেখে মহানগর সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। গঠিত হয় বরিশাল জেলা উত্তর-দক্ষিণ ও মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। প্রথম পর্যায়ে এ তিন কমিটির আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়কসহ সাতজনের নাম ঘোষণা করে কেন্দ্র। যারা প্রত্যেকেই সরোয়ার বিরোধী ফোরামের নেতা হিসাবে পরিচিত।

তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির প্রস্তাব কেন্দ্রে পাঠাতে বলা হয়। সে অনুযায়ী গত ২২ জানুয়ারি কেন্দ্রের অনুমোদন পায় ৪২ সদস্যের মহানগর এবং ৪৭ সদস্যের দক্ষিণ জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি। হাতেগোনা কয়েকজন বাদে সরোয়ার নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রায় সবাই বাদ পড়েন নতুন এ দুই কমিটি থেকে। যাদের মধ্যে রয়েছেন ত্যাগী পরীক্ষিত অনেক নেতা। শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে পদবঞ্চিতদের মধ্যে। তবে এ নিয়ে মাঠে বিক্ষোভে নামেননি তারা। পদবঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে নালিশ জানানো হয় কেন্দ্রে। এরপরও হয়তো খুব একটা জটিল হতো না যদি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন নতুন নেতৃত্ব।

বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মহসীন মন্টু বলেন, তারুণ্য-নির্ভর নতুন নেতৃত্ব দেখে ভেবেছিলাম তারা ভিন্ন কিছু করবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বের হতে পারেননি। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটিতে সক্রিয় ত্যাগী বহু পরীক্ষিত নেতার জায়গা না পাওয়া। এখন আবার দেখছি আমাদের বাদ দিয়ে দল চালানোর চেষ্টা। এটা কতটুকু ঠিক হচ্ছে তা কি কেন্দ্র দেখছে না?

মহানগর কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুল হক তারিন বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ শাসনামলে বহু মামলার আসামি হয়েছি। যারা কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন তাদের প্রত্যেকেরই মাসে অন্তত ১০-১২ দিন আদালতের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যুগ যুগ ধরে বিএনপি করে শেষ পর্যন্ত এই প্রাপ্তি? কাকে নেতৃত্বে রাখবে বা না রাখবে সেটা কেন্দ্রের ব্যাপার। কিন্তু আমরা যারা দল করতে গিয়ে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছি তাদের কী দোষ?

আরেক যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আকবর বলেন, ভেবেছিলাম আহ্বায়ক কমিটির কলেবর ছোট তাই সবার জায়গা হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটির ক্ষেত্রে এ সমস্যা থাকবে না। কিন্তু এখন দেখছি আমাদেরকে পুরোপুরি মাইনাস করার চেষ্টা চলছে। দলের কোনো কার্যক্রমে ডাকা হচ্ছে না। তাহলে দল করতে গিয়ে এই যে ১৫-২০টি মামলা খেলাম, জেল জুলুম সহ্য করলাম তার কি মূল্য দিল বিএনপি?

মহানগরের সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক আলাউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সবাইকে নিয়েই দল চালাতে হবে। এখানে যদি তারা মনে করেন, সরোয়ার অনুসারীদের বাদ দিয়ে দল চালাবে তাহলে সেটা ভুলের স্বর্গে বাস করা ছাড়া আর কিছুই নয়। মহানগর ও ৩০ ওয়ার্ড কমিটি মিলিয়ে কম করে হলেও সাড়ে ৫ হাজার নেতা রয়েছেন। তাদের বাদ দিয়ে দল চালাতে পারবে? তাছাড়া সরোয়ারের কমিটিতে থাকা মানেই তো আর তার অনুসারী নয়।

জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবায়েদুল হক চান বলেন, বর্তমান কমিটি যেসব কর্মসূচির আয়োজন করছে তার প্রায় কোনোটিতেই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। মাঝে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হলে গিয়ে দেখি, আমার চেয়ার রাখা হয়েছে দ্বিতীয় সারিতে। কষ্ট পেয়ে ফিরে এসেছি। বরিশাল জেলা উত্তর বিএনপির সাবেক সভাপতি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক সংসদ-সদস্য মেসবাহ উদ্দিন ফরহাদ বলেন, একদিকে যেমন কর্মসূচিতে দাওয়াত পাই না তেমনি দাওয়াত পেলেও গিয়ে যথাযথ সম্মান পাই না। বিষয়টি এমন যেন তারা চান না আমরা সেখানে যাই।

সাবেক সিটি মেয়র বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামাল বলেন, নতুন কমিটি গঠন হওয়ার পর আজ পর্যন্ত কেউ একটা ফোন দিয়েও জিজ্ঞাসা করেনি কেমন আছি।

মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও সদর আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য হিসাবে তারা তো আমাকে স্থানীয় কর্মসূচিগুলোতে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। কিন্তু কেন তারা সেটা করে না তারাই ভালো বলতে পারবেন। এভাবে বিভাজন তৈরি করে তারা দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে পারবেন না।

এসব অভিযোগ বিষয়ে বরিশাল মহানগর বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক বলেন, দলীয় কর্মসূচির খবর সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপরও যদি কেউ বলেন, জানেন না। তবে সেটা তাদের ব্যর্থতা। এবায়েদুল হক চানকে পেছনের সারিতে চেয়ার দেওয়ার বিষয়টি আমার অজ্ঞাতে হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। যারা অভিযোগ করছে তারা কেন নিজে থেকে দলের কর্মসূচিতে আসছেন না? আজ সরোয়ার সাহেব আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। কিন্তু তারও তো কিছু দায়িত্ব আছে। আমরা নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। উনিও তো পারেন আমাদের সঙ্গে নিজে থেকে যোগাযোগ করতে। আমাদের দিকনির্দেশনা দিতে। কিন্তু তিনি তা করছেন না। ছোট পরিসরের আহ্বায়ক কমিটিতে অনেকেই জায়গা পাননি এটা ঠিক। তবে কোনো কোরাম কিংবা পক্ষ বিবেচনা করে এটা করা হয়নি।

দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ-সদস্য বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, সিনিয়র নেতাদের যেমন সম্মান করতে হবে তেমনি দল চালাতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। এক্ষেত্রে কে কার পক্ষ সেটা জরুরি নয়। পক্ষপাতিত্ব ও মাইনাসের প্রক্রিয়ায় আর যাই হোক, দল শক্তিশালী হয় না। জেলা ও মহানগরের বর্তমান নেতৃত্ব এ দিকটাতে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। নইলে কোনো অঘটন ঘটলে কেন্দ্র অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।

 

 

কলমকথা/ বিথী