* একসঙ্গে পথ চলতে চান তারা

* অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন জরুরি

* অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা

* নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পণ্যের ঊর্ধ্বগতি

* নতুন প্রজন্মের জন্য দিতে হবে আকর্ষণীয় বার্তা

প্রায় তিন বছর পর জোটনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর অনেকটাই উজ্জীবিত ১৪ দলের শরিক নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক হয়ে পথ চলতে চান তারা। বেশ কয়েকজন জোট নেতা বলছেন, দল ছোট হোক আর বড় হোক কোনো অবস্থাতেই শরিক দল ও নেতাদের অবমূল্যায়ন করা যাবে না।

সেইসঙ্গে আদর্শিক এই জোটকে সক্রিয় রাখারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। বলছেন, আগামী নির্বাচনে শরিকদের ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব মূল দলের। পাশাপাশি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করা সম্ভব হলে নিরাপদ থাকবে বাংলাদেশ। এজন্য আসন্ন নির্বাচনের আগে মিত্রদের নিয়ে সারা দেশে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকেই। পাশাপাশি জোটে আবারো গতি ফিরবে এমন প্রত্যাশাও তাদের।

ভোরের আকাশের পক্ষে এ ব্যাপারে কথা হয় অন্তত ছয়জন শরিক নেতার সঙ্গে। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শরিক নেতাদের বৈঠকে মান অভিমান ভেঙেছে। কিন্তু জোটকে সক্রিয় রাখার বিষয়ে সবার আগে আওয়ামী লীগকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেইসঙ্গে জোট নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি কর্মসূচির রূপরেখা তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চান ঘন ঘন বৈঠকের চেয়ে একটি রূপরেখা অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হোক। আগামী ১৪ দলের বৈঠকে রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলেছেন জোট শরিক নেতারা।

কী থাকতে পারে এই রূপরেখায়। এ প্রসঙ্গে শরিক নেতারা বলছেন, উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই আদর্শিক জোট কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষবাষ্প দেশ থেকে নির্মূল করা যায়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে সুযোগ পেলেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে।

তাই আগামী দিনের ১৪ দলের কর্মসূচিতে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সভা-সমাবেশ করা যেতে পারে। এর সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ, আগামী দিনে উন্নয়ন ও সম্ভাবনার কথা জোটবদ্ধ কর্মসূচিতে তুলে ধরা যেতে পারে। এর সঙ্গে আগামী শত বছরের জন্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে করা ডেল্টা প্ল্যানও মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। সব মিলিয়ে ভোটারদের আস্থা বাড়াতে হবে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি।

তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে বেকার সমস্যার সমাধানসহ নতুন নতুন পরিকল্পনা করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

জানতে চাইলে গণতন্ত্রী পার্টির সহ-সভাপতি নূরুর রহমান সেলিম বলেন, জোটনেত্রী সবাইকে ডেকে দীর্ঘদিন পরে হলেও কথা বলেছেন। এতে শরিকদের খুশি না হওয়ার কারণ নেই। তবে তিনি একটি অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে মাঠে নামার তাগিদ দিয়েছেন। ১৪ দলকে যদি সক্রিয় করা সম্ভব না হয় তাহলে কোনো পরিকল্পনা মাঠে গড়াবে না। এজন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমন্বয় জরুরি বলেও মত দেন তিনি।

জোটের আরেক শরিক গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, আমরা সবাই একমত ১৪ দলে থেকেই আগামী নির্বাচন করব। কিন্তু মাঠে ১৪ দল কী বলবে। এজন্য দ্রুত কাজ শুরু জরুরি। যে আদর্শের ভিত্তিতে জোটের যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশের প্রেক্ষাপটে কোনো কিছুই অতীত হয়ে যায়নি। চলমান আছে। তাই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে জাগরণ তৈরি করতে হবে। মানুষকে ভালো কিছুর আশায় স্বপ্ন দেখাতে হবে। তরুণ প্রজন্মের জন্য ভালো কিছু ঘোষণা করতে হবে। তবেই ১৪ দল তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এগিয়ে যেতে পারবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরো দুজন শীর্ষ নেতা বলেন,পণ্যের ঊর্ধগতি নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ১৪ দলের নেতাদের জেলা-উপজেলাভিত্তিক কাজ করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।একেবারেই সাধারণ মানুষের জন্য সরকারের সহায়তা কর্মসূচিগুলো শতভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা মাঠপর্যায়ে তদারকি করার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা।

গত ১৫ মার্চ বাড়িতে ডেকে নিয়ে ১৪ দল নেতাদের মান ভাঙিয়েছেন জোট নেত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সর্বশেষ ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছিল। নির্বাচন শেষে শরিক নেতাদের কেউ মন্ত্রী পরিষদে ঠাঁই পাননি। তাছাড়া আসন বণ্টন নিয়েও শরিকদের কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। এর মধ্যে বিগত তিন বছর জোট নেতাদের খোঁজখবর পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। নামে মাত্র ১৪ দলীয় জোট থাকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শরিক নেতাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। আগামী নির্বাচন ১৪ দলীয় জোটে হবে কি না এ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন শরিক নেতাদের কমবেশি সবাই।

এই পরিস্থিতিতে গত ১৫ মার্চ জোটনেত্রী ও প্রধানমনস্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাস ভবন গণভবনে শরিক নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠক থেকে বের হয়ে শরিক নেতারা বলেন, ১৪ দলেই আগামী নির্বাচন হবে। বৈঠকে শরিক নেতাদের কেউ কেউ নিজেদের মান অভিমানের কথা জোট নেত্রীর কাছে তুলে ধরেন। বলেন, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শরিকদের তেমন একটা মূল্যায়ন করা হয়নি। তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নামেমাত্র ১৪ দল টিকে ছিল।

কেউ কেউ বলেন, আগামী নির্বাচন ১৪ দলে হবে কি না এ নিয়ে আমরা সবাই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে। সেইসঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উগ্র-সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীকে মোকাবিলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নিত্যপণ্যের চলমান পরিস্থিতি, বিএনপির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি কমানোসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় স্থান পায়।

এ সময় শরিক নেতারা নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, সবার আগে বদনাম ঘোচানো জরুরি। নেতাকর্মীদের নানা অপকর্মের কারণে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই অপরাধী যে দলেরই হোক তাকে ছাড় না দিতে পরামর্শ দেন শরিক নেতারা।

শরিক নেতাদের আলোচনার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ১৪ দল নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। একসঙ্গে সবাই মিলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাই। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবিলা করে মানুষের কাছে যেতে হবে। সরকারের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রার কথা সবার কাছে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে একটি অ্যাকশন প্রোগ্রাম নিয়ে সবাই মিলে মাঠে থাকার পক্ষে মত দেন জোট নেত্রী। তার মতের সঙ্গে শরিক নেতারা সহমত পোষণ করেন।

বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছেন জোট নেতাদের সবাই। যদিও জোটের সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু। তাই পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে আমুর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন অনেকেই। কারো কারো মত হলো, প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া মানেই সবকিছু আগের মতো চলমান থাকবে। গতি ফেরাবে জোটে।

বাংলাদেশ গণআজাদী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এস কে সিকদার বলেন, দীর্ঘদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে জোট শক্তিশালী করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এখন আমরা জোটের গতি ফেরার অপেক্ষায়। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হবে।