বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লন্ডনে ফোন করেছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন ১০ তারিখে আসলে ঠিক কী করতে চাইছে বিএনপি?
তাকে জবাব দেয়া হয়েছে, ১০ তারিখে বিএনপি আসলে কী করবে বা করতে চাইছে তা আপনাকে জানানো হবে ৯ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে দলের ভেতরকার এই বিষয়টি।
একটি বৃহৎ দল যেটি একাধিকবার দেশের ক্ষমতায় থেকেছে, সেই দলের বৃহৎ কর্মসূচির সারবস্তু বিষয়ে তার মহাসচিবকে যখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষে এমন ধোঁয়াসা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ জবাব দেয়া হয় তখন আর কোনো কিছুই অষ্পষ্ট থাকে না।
এই ঘটনার সূত্র ধরে রাজনৈতিক মহলে বিশেষ করে বিএনপি দলীয় আবহে একটি কানাঘুঁষা চাউড় হয়েছে। আর সেটি হচ্ছে- মির্জা ফখরুলকে কি শেষ পর্যন্ত সরে যেতেই হচ্ছে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন মধ্যম শ্রেণির নেতা জানালেন, মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলের বিকল্প ভাবা হচ্ছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ অথবা স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে। দলটির পলাতক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সেই সময় কোনটি?
এমন প্রশ্নের জবাবে সূত্র জানায়, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশ সামনে বিধায় বিষয়টি চেপে রাখা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভাগীয় মহাসমাবেশ এবং সবশেষে রাজধানীতে ১০ তারিখের সমাবেশের পটভূমিতে নেতাকর্মীদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পরে, এমন চিন্তায় ফখরুলকে মাইনাসের প্রবল বাসনা দমিয়ে রাখা হয়েছে।
কারণ, বেগম জিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট ফখরুল দীর্ঘদিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত এবং পরবর্তীতে পরিপূর্ণ মহাসচিব থাকার সূত্রে দলীয় নেতাকর্মীদের বিরাট অংশের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। বিএনপির ওপর থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত চেয়ারপারসনের পছন্দের নেতা হিসেবেই এই ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এমন একজন নেতাকে সরিয়ে দেওয়া বা সুপারসিড করাটা কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাই এমন গুরুতর পদক্ষেপ নেয়ার আগে দলটির ‘লন্ডন ব্যুরো’ মনে করছে- নিজের ইচ্ছার পক্ষে চেয়ারপারসনের শক্তপোক্ত সম্মতি আদায় যদি সম্ভবও হয় সেক্ষেত্রে সেই সময়টা ঠিক এখনি নয়, এরজন্য ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর যে কোনো সময়ে যে কোনো ইস্যুতে মির্জা ফখরুলের মহাসচিব পদ কেড়ে নেওয়া হবে।
আর তাই “১০ তারিখে বিএনপি আসলে কী করবে বা করতে চাইছে তা আপনাকে জানানো হবে ৯ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে” বক্তব্যের পর থেকে মির্জা ফখরুল খুবই হতোদ্যম আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন বলে জানা গেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘনিষ্ঠজনদের সূত্রে।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার মহাসচিবকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। যদিও আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে আসন্ন নির্বাচনে দলটির মূল চেয়ারম্যান এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এতিমদের টাকা আত্মসাতের মামলায় আদালতের রায়ে সাজা ভোগরত অবস্থায় ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুকম্পায় জামিনে থাকা মাতা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক পুত্রের অবর্তমানে দলটির মহাসচিবেরই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখার কথা।
মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে তার নিজ দলীয় প্রতিপক্ষের অভিযোগ অনেক এবং এগুলো দেশের রাজনৈতিক মহল ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অবগত। ২০১৮ সালে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে তারেক রহমানের অসম্মতি থাকলেও মির্জা ফখরুল ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে মিলে বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনে যান। কিন্তু তাতে কাঙ্খিত ফল আসেনি। তারেক ও তার পক্ষের নেতারা মনে করছেন, ২০১৮ সালের সেই নির্বাচনে ঈক্যফ্রন্টের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিএনপি কিছু আসনে জয়ী হলেও বিরোধী দলের প্রধান হতেন মির্জা ফখরুল। সেই সূত্রে তিনি হতেন প্রধানমন্ত্রী। আর নিজের দল বিজয়ী হলেও প্রধানমন্ত্রী ফখরুলই হতেন। কারণ সাজাপ্রাপ্ত বেগম জিয়া ও পলাতক তারেক রহমানের সেই সুযোগ নেই। বিএনপির ‘লন্ডন ব্লক’ মনে করছে এই সমীকরণকে মাথায় রেখেই মির্জা ফখরুল নির্বাচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন যেখানে তারেক চাইছিলেন এর উল্টো।
বিষয়টি পুরো ঠাহর হতেই ওইসময় নির্বাচনের আগেরদিন হঠাৎ অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তাই লন্ডন থেকে নির্বাচনের আগের সারাটা দিন ও রাত জুড়ে ফোনের পর ফোনে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন তিনি দেশের সবগুলো আসনের নেতাকর্মীদের। একপর্যায়ে নির্বাচনী কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন প্রার্থীদের। এর ফল হয়, নির্বাচনের দিন দেশে অবস্থানরত দলের বিপদের সময়ের কাণ্ডারী মহাসচিবকে না জানিয়েই ৪৪ জন প্রার্থী ভোট বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বসেন। আর শতাধিক প্রার্থী করেন আরো বড় ‘রাজাকারি’। তারা নীরবে ভোটের মাঠ থেকে প্রত্যাহার করে নেন কর্মীদের। মির্জা ফখরুল যখন পুরো বিষয়টি জানতে পারেন তখন তিনি হতবাক হয়ে যান। এর আগে বিভিন্ন ঘটনায় চলমান তিক্ততা এবার চরম রূপ নেয়।
আর তাই এবার ১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে বিএনপির অভ্যন্তরীন যে শতরঞ্জ খেলা চলছে, তাতে মির্জা ফখরুলও মাথার খেল দেখাতে বদ্ধপরিকর হয়ে অস্ত্র শানাচ্ছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বা কর্নেল অলির মতো বিএনপিতে হঠাৎ করেই ‘আমি কার খালু’ পরিস্থিতির মুখে পড়তে চান না তিনি। তাই যখনি তিনি নিশ্চিত হবেন যে তাকে মাইনাসের মাহেন্দ্রক্ষণ নির্ধারিত হয়ে গেছে তখনি তিনি নিজের অস্ত্র ছুড়বেন।
বিএনপির মধ্যম ও উচ্চ পর্যায়ের যে কজন পরীক্ষিত নেতা আছেন তারা সবাই বিশ্বাস করেন যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত এবং কর্মকাণ্ডের কারণে এর আগে বিএনপিকে অনেক গোনাগারি দিতে হয়েছে। নিজেরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিরোধী দলের প্রধানকে হত্যার লক্ষ্যে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চারিয়ে ২৪ জন নিরপরাধকে হত্যা, জঙ্গি তোষণ, হাওয়া ভবন দুর্নীতি, খোয়াব ও খাম্বা কাণ্ড, জামায়াতপ্রীতি, অপরিণামদর্শী ‘ইতিহাস চর্চা’, একের পর এক কাণ্ডজ্ঞানহীন ‘ফর্মুলা’র ব্যর্থ প্রয়োগ- সবই গেছে বিএনপি ও এর দলীয় নেতাকর্মীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
এই ক্ষতির খতিয়ান অনেক বড়।
তাই তারেক বিরোধীরাও নড়েচড়ে বসেছেন, গোপনে গোপনে সমমনাদের সঙ্গে বারান্দা বৈঠক, শলা করছেন। সাম্প্রতিক প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশেও এমন বেশকিছু মির্টিং হয়েছে। তারা উদ্ভট আইডিয়াবাজ নেতার ধারাবাহিক তুঘলকি কাণ্ডকীর্তি আর তার করুণ পরিণতিতে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। তারা বুঝে গেছেন, মাইনাস মির্জা ফখরুল প্ল্যানের সুর। তাই তারা চাইছেন, ফখরুলকে ঘিরে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করতে। প্রয়োজনে ‘মাইনাস ভারপ্রাপ্ত’ ফর্মুলার প্রয়োগও হতে পারে। জানা গেছে, নিরূপায় হলে বা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা তাই করবেন। আর মির্জা ফখরুলও তিক্ততার চরমে পৌঁছে গেছেন। তার পক্ষের নেতারা বলছেন, সবকিছু বাদ দিয়েও ২০১৩-১৪ সালে দলের চরম দুর্যোগপূর্ণ সময়টায় তিনি যথেষ্ট কুশলতা আর নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে দলকে রক্ষা করেছেন ভাঙন থেকে, সেই ব্যক্তিটিকে এখন একব্যক্তির বালখিল্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বলি হতে হবে!
তাই তারাও কোমড় বেঁধে আছেন। একদিকে ঢিলটি পড়লে উল্টোদিক থেকে পাটকেলটি ছোড়ার জন্য তারাও প্রস্তুত। আর এমন কিছু হলে অনেকদিন পর ফের বিএনপিতে দেখা দেবে ভাঙন, এবং তা হবে বড় আকারে। ফলস্বরূপ একদিকে দেখা যাবে জামায়তপন্থি তারেক জিয়ার অধীন বিএনপি অন্যদিকে মির্জা ফখরুলপন্থি বিএনপি।
তবে এই যে বিএনপির অভ্যন্তরে এতকিছু ঘটে চলেছে তা নিয়ে মুখ খুলছেন না কেউ-ই প্রকাশ্যে। এটাই বড়সর সুনামির পূর্বলক্ষণ বলে মনে করছেন অনেকে। মির্জা ফখরুল সংবাদ সম্মেলনে, জনসভায় তারেক জিয়ার নাম নিতে গেলে তার নামের আগে ‘সাহেব’ যোগ করে কথা বলছেন। যাতে বয়সে অনূজ, অভিজ্ঞতায় হাঁটুসমান হওয়া সত্ত্বেও দলের ‘মহামান্য’ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কোনো অজুহাত খুঁজে না পান যে মহাসচিব তাকে ‘অসম্মান’ করেছেন। কিন্তু ভেতরে চলছে সম্পূর্ণ অন্য খেলা। গত নভেম্বরের গোড়ার দিকে বগুড়ায় দলের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত প্রধান অতিথি মির্জা ফখরুল দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, মনে রাখবেন এটাই আমাদের শেষ লড়াই, এ লড়াইয়ে আমাদেরকে জিততেই হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের এই লড়াই বিএনপির স্বার্থে নয়, তারেক রহমানের স্বার্থে নয়, খালেদা জিয়ার স্বার্থে নয়। এই লড়াই এদেশের জনগণের স্বার্থে, এদেশ রক্ষার স্বার্থে এবং এই জাতিকে রক্ষা করার স্বার্থে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষ নেতাদের অনেকে মানছেন, এই কটি লাইনের মধ্যে ফখরুলের ক্ষোভমিশ্রিত মনের কথা লুকিয়ে আছে। তিনি বলেছেন, এই লড়াই বিএনপির স্বার্থে নয়, তারেক রহমানের স্বার্থে নয়, খালেদা জিয়ার স্বার্থে নয়। তিনি শেষে বলেছেন জনগণের স্বার্থে তাদের লড়াই। তবে মাঝখানে যে চারটি শব্দ ব্যবহার করেছেন ফখরুল এটাই তার আসল কথা, সেটি হচ্ছে তার লড়াই ‘তারেক রহমানের স্বার্থে নয়’। এরপর জনগণের স্বার্থে যতটুকু লড়াই তিনি করতে চান তার বাইরে গিয়েও বলতে হয়, আগে তো নিজেকে বাঁচাতে হবে, তারপর না দল! রাজনৈতিক পরিস্থিতিগত কারণে তিনি এখন দলের এমনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যে সামনে বিরোধী দলীয় প্রধান হন বা ক্ষতাসীন জোটের প্রধান- প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা তার জন্য একেবারে অসম্ভব নয়। তাই লড়াইটা তিনি জনগণের স্বার্থের আড়ালে নিজের জন্যও দিতে চান।
এমন পটভূমিতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনেকেই অশনির সংকেত দেখতে পাচ্ছেন। তা হচ্ছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার হঠানোরে আন্দোলন শেষতক না আবার বিএনপি বিভাজনের আত্মঘাতী চণ্ডালবৃত্তিতে রূপ নেয়! মুখ না খুললেও এমন বুমেরাং ভীতিতে ভুগছেন এখন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।