সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা ও মানবতার ধর্ম ইসলাম। মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করে ইসলাম। পৃথিবীতে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করেছে তার আদর্শের জাদুমন্ত্রে; পেশিশক্তির জোরে নয়।

ইসলাম আত্মপ্রকাশের অল্প দিনেই অর্ধপৃথিবী জয় করার পেছনে মূল শক্তিটি ছিল ইসলামের আদর্শ, উদারতা ও মানবতাবোধ। আসলে ইসলাম প্রথমে মানুষের হৃদয় জয় করেছে, তারপর পৃথিবী জয় করেছে। প্রথমে মানুষের প্রকৃতিগত গুণ তথা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়েছে।

ইসলামের শিক্ষা হলো, প্রথমে ভালো মানুষ হতে হবে, পরে ভালো মুসলমান। যিনি ভালো মুসলমান তিনি ভালো মানুষও বটে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা প্রকৃত মুমিন না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার পরস্পরকে ভালোবাসতে না পারা পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না’। (বুখারি ও মুসলিম)। অর্থাৎ প্রকৃত মুমিন হতে হলে অন্তরে মানবপ্রেম জাগাতে হবে।

পরমতসহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। অপরের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রতিটি মানুষ সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, নারী হোক কিংবা পুরুষ, মানুষ হিসেবে মহান আল্লাহ তাকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মানবজাতিকে মর্যাদাবান করেছি, আমি তাদের স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি আমার সৃষ্টিজগতের অনেকের ওপর।’ (সূরা: বনি ইসরাইল, আয়াত: ৭০)।

মহানবী (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের পরস্পরের জীবন, ধন-মাল ও সম্মান পরস্পরের জন্য সম্মানের যেমন তোমাদের এ দিনটি সম্মানের, এ মাসটি সম্মানের এবং এ শহর সম্মানের’। (বুখারি : ৬৭)।

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতেন। একবার আমাদের মহানবীর পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি ওই লাশের সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাকে বলা হলো, লাশটি তো একজন ইহুদির। মহানবী (সা.) বললেন, সে কি মানুষ নয়? (মুসলিম : ৯৬১)।

মানুষের মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করাকেও ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের কোনো সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে যেন বিদ্রুপ না করে’। (সূরা: হুজুরাত, আয়াত: ১১)।

আর কোনো মানুষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ইসলামে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,‘ধ্বংস এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দা করে।’ (সূরা: হুমাজা, আয়াত: ১)। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘হে ইমানদাররা! কোনো সম্প্রদায় যেন অন্য কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। ইমানের পর মন্দ নাম কতইনা নিকৃষ্ট! যারা এমন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই জালেম।’ (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১১)।

কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেয়প্রতিপন্ন করা মুমিনের কাজ নয়। বরং তা সংকীর্ণ মানসিকতার লক্ষণ। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের দোষ অনুসন্ধান কোরো না। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ করো না ও পরস্পর শত্রুতা করো না। বরং হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি: ৪৮৪৯)।

মানুষের প্রতি কু-ধারণা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয়। কোনো দলিল-প্রমাণ ছাড়া অনর্থক কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করাকে ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা সব ধরনের অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। কেন না কিছু কিছু অনুমান গুনাহের কারণ। আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। তোমরা পারস্পরিক গীবত থেকেও বিরত থাকো।’ (সূরা: হুজুরাত, আয়াত: ১২)।

তা ছাড়া ঘৃণার পরিবর্তে সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার প্রসার ঘটানো ইসলামের মহান শিক্ষা। রাসূল (সা.) মুমিনদের ভালোবাসা ইমানের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে বলেছেন, ‘ইমান ছাড়া তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, পরস্পরকে ভালোবাসা ছাড়া তোমরা মুমিন হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ের কথা বলে দেব না, যাতে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা পরস্পরকে সালাম দেবে।’ (মুসলিম: ২০৩)।

পৃথিবীর কোনো মানুষকে অমর্যাদা করা ইসলামের শিক্ষা নয়। অমুসলিম ও সংখ্যালঘুদের অধিকারেও ইসলাম কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখো, যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিক বা সংখ্যালঘুকে আঘাত করে বা তাকে অপদস্থ করে অথবা কর্মচারী নিয়োগ করে তার সাধ্যের বাইরে কাজ চাপিয়ে দেয়, আমি তার বিরুদ্ধে কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর দরবারে মামলা করব।’ (আবু দাউদ : ২/৪৩৩)।

মহানবী (সা.) মদিনায় যখন একটি নতুন রাষ্ট্র স্থাপন করেন, তার ভিত্তি ছিল ‘মদিনা সনদ’। এ সনদের একটি ধারা হলো, সব ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। মদিনার ইহুদিরা প্রায়ই ইসলামের বিরোধিতা করত, তথাপি রাসূল (সা.) তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। একবার মদিনার মসজিদে বসে নবী করিম (সা.) নাজরান থেকে আসা একটি খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিরতিতে তারা নিজ ধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী করিম (সা.) তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন। (ফুতুহুল বুলদান : পৃ. ৭১)।

অমুসলিমদের অধিকার ইসলামের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য। ফিলিস্তিন জয়ের পর খলিফা ওমর ফারুক (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিষ্টানদের একটি সংবিধান লিখে দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো, এ চুক্তিনামা ইলিয়্যাবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিষ্টানদের জানমাল, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না এবং কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন বা হামলা করা যাবে না।’ (তারিখে তাবারি : ২/৪৪৯)।

তবে সময়ের স্রোতে আজ মুসলমান ইসলামের মর্মবাণী ভুলে যেন আত্মবিস্মৃত। সৌজন্য ও মানবতাবোধ হারিয়ে ক্রমেই যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সবাই। কেউ কাউকে ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। মানবতার জায়গা দখল করে নিয়েছে স্বার্থপরতা ও ভোগলিপ্সা। একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সবাই। পৃথিবীতে সুন্দর ও শান্তিময় করতে হলে আবারও ফিরে যেতে হবে ইসলামের উদার পাঠশালায়। জোগাড় করতে হবে ইসলামের উদারতা ও মানবতাবোধের শিক্ষা।p