সদগুরু: অর্জুনের জীবনে একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ হয়ে ওঠা। তিনি একজন মহান যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু হতোদ্যম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ ও একনিষ্ঠ হলেও সারাটা জীবন তিনি ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। সর্বক্ষণ তাঁর এটাই চিন্তা ছিল যে এই বুঝি আর কেউ তাঁর চেয়ে দক্ষ ধনুর্বিদ হয়ে উঠল। এটা ঠেকাতে তিনি নানা অমানবিক কাজ করেছেন।
অর্জুনের নানা বিস্ময়কর গুণ থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তাহীনতা দ্বারাই তিনি চালিত ছিলেন।
একদিন একলব্য নামের এক বালক দ্রোণের কাছে এলেন। তিনি আর্য ছিলেন না, একজন নিষাদ ছিলেন, যেটা ভারতের আদিবাসী উপজাতিগুলির মধ্যে একটা। শাস্ত্রে তাঁর বর্ণনা এরকম – তাঁর চলন ছিল চিতাবাঘের মতন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণবর্ণ, জটাধারী, সৌম্য এক মানুষ যিনি প্রভূত শক্তির অধিকারী। তিনি ধনুর্বিদ্যা শিক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দ্রোণ বললেন, “তুমি ক্ষত্রিয় নও, তাই আমি তোমায় শিক্ষা দিতে পারি না।”

ছেলেটা দ্রোণের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেন, “সামাজিক রীতিনীতি আমি বুঝি। আমায় কেবল আশীর্বাদ করুন। আপনার আশীর্বাদ থাকলে আমি শিখে নিতে পারব।” এরকম বিনয় ও একাগ্রতা দেখে দ্রোণ তাঁর হাত একলব্যের মাথায় রেখে বললেন,”আমি তোমায় আশীর্বাদ করলাম।” একলব্য জঙ্গলের মধ্যে চলে গেলেন। নদীর কাদামাটি দিয়ে তিনি দ্রোণের মূর্তি গড়তে শুরু করলেন, যেন মগ্ন হয়ে গেছেন। আপনি যদি একজন মহান গায়ক হতে চান, আপনার শুধু দারুণ গানের গলা থাকলেই হবে না – আপনার খুব ভাল কানও থাকতে হবে। আপনার তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তির জন্যই আপনি একজন সঙ্গীতশিল্পী হয়ে উঠতে পারেন। একইভাবে আপনি যদি তীরন্দাজ হতে চান, এটা শুধু আপনার হাতের বিষয়ই নয়, এটা আপনার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতার বিষয় – কত সূক্ষ্মভাবে আপনি কোনোকিছু পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং কত একাগ্রভাবে আপনি আপনার মনঃসংযোগ ধরে রাখতে পারছেন।

পাখির চোখ
অর্জুন এই সমস্ত গুণই প্রদর্শন করেছিলেন। একদিন তাঁরা যখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন, দ্রোণ পাণ্ডব ও কৌরবদের তীরন্দাজির দক্ষতা যাচাই করে দেখতে চাইলেন, সেইজন্য তিনি একটা গাছের মগডালে একটা কাঠের পাখি রেখে তাঁদের বললেন ওই পাখির চোখটাকে নিশানা করতে। একে একে প্রথমে কৌরবরা ও তারপর পাণ্ডবরা নিশানা করলেন। দ্রোণ তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, “কী দেখতে পাচ্ছ?” তাঁরা নানা জিনিস বললেন – “একটা পাতা, গাছটাকে, একটা আম, পাখিটা, আকাশ।” দ্রোণ তাঁদের সবাইকে সরিয়ে দিলেন। অবশেষে অর্জুনের পালা এল।

দ্রোণ যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী দেখতে পাচ্ছ?” অর্জুন উত্তর দিলেন, “আমি পাখির চোখ দেখতে পাচ্ছি।” দ্রোণ বললেন, “একমাত্র তুমিই উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত”, দ্রোণ তাঁকে ধনুর্বিদ্যার সূক্ষ্ম কলা-কৌশল শেখালেন যার মধ্যে চোখ বন্ধ করে তীর ছোঁড়া, অন্ধকারে তীর ছোঁড়া – এমনকি লক্ষ্যবস্তুকে না দেখে লক্ষ্যভেদ করাও ছিল। তিনি প্রতিদিন ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা ঘরে অর্জুনকে খাবার খেতে বাধ্য করতেন। তিনি তাঁকে বলতেন, “তুমি যদি না দেখে তোমার মুখে খাবার তুলতে পারো, তাহলে তোমার শত্রুকে না দেখে তার বুকে তীর বিদ্ধ করতে পারবে না কেন?”

একলব্যের অবিচল একাগ্রতা
এই সমস্ত উন্নত কলা-কৌশলের প্রশিক্ষণ পেয়ে অর্জুন বিশ্বাস করতে লাগলেন যে তিনিই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ কিন্তু তখনই একলব্য এসে দ্রোণের আশীর্বাদ নিয়ে বনে ফিরে গেলেন। একলব্য যখন দ্রোণের কাছে এসেছিলেন, তিনি দ্রোণের সামান্যতম খুঁটিনাটি বিষয়েও মনোযোগ দিয়েছিলেন।

এটাই একজন ধনুর্বিদের গুণ – কোনোকিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। কোনোকিছু দেখার সময়ে কেউ যদি খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তীর ছোঁড়ার সময়েও অবধারিতভাবে সে ওগুলো লক্ষ্য করতে পারবে না। দ্রোণের ছবি যেহেতু তিনি মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলেন, ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর একটা মাটির মূর্তি তৈরি করলেন আর এই মূর্তির সামনে প্রণাম করে দ্রোণের আশীর্বাদ নিয়ে অনুশীলন শুরু করলেন।

 

কলমকথা/সাথী