তৈয়বুর রহমান কিশোর,বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি: পরিবারে একটু সহযোগিতা করতে প্রায় দুই বছর আগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দ্বারে গিয়েছিলেন রোকেয়া বেগম (৫২) নামে এক নারী।
এলাকার ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে আকুতি মিনতিতে ৫০০ টাকার বিনিময়ে পেয়ে যান একটি ভিজিডি কার্ড। প্রথমবার ভিজিডি কার্ডের সহযোগিতা পেলেও বন্ধ হয়ে যায় সেই সহযোগিতার হাত। কেড়ে নেওয়া হয় তার সহায়তা কার্ড। এরপর তার নামে প্রতিবারই আসতে থাকে সরকারি চাল, ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ কিন্তু একবারও সেসব সামগ্রী পৌছেনি তার দুয়ারে।
শুধু রোকেয়া বেগম নয় এই ইউনিয়নে এ ধরনের ৪০ জন ব্যক্তির নামে মাসের পর মাস আসতে থাকে সরকারি সহযোগিতা। তাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না তাদের নামে কোন সরকারি সহায়তার কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু উপকারভোগীদের তালিকায় রয়েছে তাদের নাম ঠিকানা। এই কার্ডের উপকারভোগীদের পরিবর্তে সেই চাল—ডাল সামগ্রি যাচ্ছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের পকেটে। সরেজমিনে এমনই অভিযোগ উঠে এসেছে। এছাড়া কোটি কোটি টাকায় গড়ে তোলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে না গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অফিসকে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় বানানো হয়েছে।
শেখর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের কৃষক ফেরদৌস মোল্যার স্ত্রী রোকেয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, অনেক ঘুরাঘুরি করে চেয়ারম্যানকে ৫০০ টাকা দিয়ে একটা কার্ডের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সেটা অন্য একজনের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে বলে চেয়ারম্যান এবং তার কাছ থেকে ২৫০ টাকা নিয়ে নিতে বলে। কিন্তু ওই লোক ভাগে কোন কার্ড নিতে চায় না। বিষয়টি আমি চেয়ারম্যানকে জানালে সে আমাকে রাগ করে বলে ভাগে খাইলি খাবা না হলে যাওগে। তার কথা মেনে নিয়ে একবার সহায়তা উঠালাম। বিষয়টি আমি এলাকার গ্রাম পুলিশকে বললে, চেয়ারম্যান আমার উপর রেগে যায়। এরপর আমার হাত থেকে কার্ড রেখে অফিস থেকে বের করে দেয়। সেই থেকে ১৮ মাস আমি কোন চাল ডাল পাই না।
নামে কার্ড বরাদ্দ আছে তবুও চাল—ডাল পায় না রোকেয়া বেগমের মতো ৪০ জন আছে এ ইউনিয়নে। তাদের নামে আসা সকল চাল, ডাল আত্মসাৎ করছেন চেয়ারম্যান নিজেই! বিষয়টি অনেকেই জানতে পেরে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছেন। মাসের পর মাস সরকারি রিলিফের খাদ্য সহায়তা না পেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন হতদরিদ্র পরিবারগুলো।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়নে ২৪০ জনের নামে ভিজিডি কার্ড বরাদ্দ রয়েছে। এরমধ্যে ইউপি সদস্যদের ৫—৬টি করে কার্ড দিয়ে চেয়ারম্যান নিজেই কিছু বিতরণ করেছেন। বাকিগুলো বিভিন্ন মানুষের নামে কৌশলে ইস্যু করে চেয়ারম্যান আত্মসাত করে যাচ্ছেন। এই অভিযোগপত্রে কার্ড বরাদ্দ পাওয়া ৩০ জন ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই সুবিধাভোগীদের তালিকা ৫০০ টাকাসহ তাদের ভোটার আইডি কার্ড, ছবি দিয়েছিলেন ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে। কিন্তু পরবর্তিতে তারা জানতেনই না তাদের নামে সরকারি সহায়তার কার্ড ইস্যু হয়েছে।
ভিজিডি কার্ডের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে নিজের ছবি ও কাগজপত্র দিয়েছিলেন ওই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রাখালতলী গ্রামের জোসনা বেগম। কাগজপত্র দেওয়ার পর থেকে তিনি জানতেও পারেননি তার নামে কার্ড আছে। কিন্তু ভিজিডি কার্ডের তালিকায় ১২৩ নম্বরে নাম রয়েছে জোসনার। তিনি বলেন, আমার নাম ও ছবি নিয়েছিল কিন্তু আজও আমরা কিছু পাইনি।
ভিজিডি কার্ডের তালিকা ধরে যাওয়া হয় ওই ইউনিয়নের বারাংকুলা গ্রামের মো. দেলোয়ার কাজীর বাড়িতে। বাড়ির চারদিকে টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা, ভেতরে আধাপাকা জোড়া ঘর রয়েছে। বাড়ি দেখে মনে হয় না কোনো হতদরিদ্রের বাড়ি। অথচ ওই তালিকায় ১২৭ নম্বরে দেলোয়ার কাজীর স্ত্রী লিমা সুলতানার নাম রয়েছে। বিষয়টি জানতে চাইলে দেলোয়ার কাজী হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি জানেনই না তার স্ত্রীর নামে কোন কার্ড ইস্যু হয়েছে। তিনি বলেন, আমার জানামতে কোনো কার্ড নেই। এমনকি কোনো সুবিধাও পাইনি। আমিতো কখনও আবেদনই করি নাই। আল্লাহ জানে কেমনে কি হয়েছে।
সরকারি অফিস রেখে নিজের ব্যক্তিগত অফিসে কার্যক্রম করায় জনসাধরণের ক্ষোভঃ
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ২৯টি গ্রাম নিয়ে শেখর ইউনিয়ন গঠিত। যার জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়টি ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চরশেখর গ্রামে। গ্রামটি ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে থাকায় দীর্ঘদিন এখানে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। এ গ্রামের নামেই নামকরণ করা হয়েছে ইউনিয়নটির। ২০১০—১১ অর্থবছরে ইউনিয়ন কার্যালয়ের আধুনিকায়ন করে নির্মিত হয় দুই তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবন।
গত শনিবার ও রবিবার সরেজমিনে এলাকা ঘুরে জানা যায়, আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ইউনিয়ন কমপ্লেক্স এখন জরাজীর্ণ ও জনশূণ্য অন্ধকার ভবনে পরিনিত হয়েছে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর একদিনও সেখানে অফিস করেননি কামাল আহমেদ। এমনকি সেখানে কোনো কার্যক্রমই চলে না। কোন কোন সময় ভবনটিতে অনেকেই গরু ছাগল পালনের কাজেও ব্যবহার করছে। সরকারি দৃষ্টিনন্দন অফিস রেখে চেয়ারম্যান সহস্রাইল বাজারে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেই চালান ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত আড়াই বছর নির্বাচিত হলেও একদিনের জন্যও দৃষ্টিনন্দন ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে অফিস করেননি চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ। যে কারনে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে দূরদুরান্ত থেকে আসা জনসাধারণ। চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অফিসে গেলে সচিব ও সেখানে দায়িত্বে থাকা লোকজন বাড়তি টাকা ছাড়া কাজ করে দেয় না।
৬৫ বছর বয়সী ওই ইউনিয়নের তেলজুড়ি গ্রামের বাসিন্দা লাট্টু মিয়া বলেন, বাপ—দাদার আমল থেকেই এখানে ভোট অফিস দেখে আসতেছি। এ পর্যন্ত যারাই চেয়ারম্যান হয়েছে সকলে এখানেই অফিস করেছে। কিন্তু এই লোক হওয়ার পরে তার চেহারাই আমি দেখি নাই। কি জন্য এই অফিস বন্ধ হয়ে গেছে আমরা জানিনা। আমাদের বাড়তি টাকা দিয়ে তার অফিসে যেতে হয়।
রবিবার (৭ জুন) এ বিষয়ে জানতে ইউপি চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেনের ব্যক্তিগত অফিস সহস্রাইল বাজারে যাওয়া হয়। সেখানে কম্পিউটার রুমে একটি ছেলেকে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে ইউপি চেয়ারম্যান কামাল আহমেদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে যা কিছু হচ্ছে এসব ষড়যন্ত্র। সকল অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, কোন কার্ডই আত্মসাত করার প্রশ্নই ওঠে না। যতগুলো কার্ড রয়েছে প্রত্যেকেই নিজেই মালামাল তুলে নেন। তিনি আরো বলেন, কারো চাল—ডাল মেরে খাওয়া তো দূরের কথা প্রতিমাসে ২০০জন মানুষকে নিজের তহবিল থেকে ১০ কেজি করে কার্ডের বাইরেও চাল দেন তিনি।
ইউনিয়ন কমপ্লেক্স রেখে দূরের ব্যক্তিগত অফিসে কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ইউনিয়নটি অনেক বড়। সেজন্য দুই জায়গায়ই আমি অফিস পরিচালনা করি। আমার নিরাপত্তার জন্য আমি সস্রারাইল অফিসে বসি। আর সচিব ও গ্রাম পুলিশরা ইউনিয়ন কমপ্লেক্সে থাকেন। এলাকায় দল পাল্লা থাকে, যে কারনেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরেই জেলা প্রশাসনের একজনকে কর্মকর্তাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী ৭দিনের মধ্যে উভয়পক্ষের সাথে কথা বলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে। তারা দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।