বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি: ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের তিন ফসলি জমির মাটি কেটে খাদ বানিয়ে ট্রলিতে ও ড্রাম ট্রাকে করে মাটি নেয়া হচ্ছে ইটভাটায় এবং বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।

মাটি কাটা বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বোয়ালমারী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের শিবপুর গ্রামে অবস্থিত জেলা পরিষদের পুকুরের পূর্ব পাশের হাসেম শেখের মালিকানাধীন ফসলি ক্ষেতের মাটি গত ১৫/২০ দিন ধরে ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেন, হাসেম শেখের ফসলি জমিতে পুকুর কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা এবং রাতেও মাটি টানার ট্রলিতে করে এসব মাটি নেয়া হচ্ছে ভাটায়।

এর ফলে ইট বিছিয়ে পুকুরের পাড়ের উপর তৈরি করা সংকীর্ণ সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এতে সামনে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে পুকুরের পাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। আঞ্চলিক ও গ্রামীন পাকা রাস্তা এবং ইট ও কাঁচা রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ট্রলির দাপটে পথচারী ও স্কুল গামী শিক্ষার্থীরা রাস্তায় চলাচলে নানা রকমের সমস্যায় পড়ছে।

এদিকে, উপজেলার চতুল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে জাহিদ সিকদারের ফসলি জমি থেকে গত ১৫ দিনেরও অধিক সময় ধরে মাটি কাটা হচ্ছে। কর্তনকৃত মাটি বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। বেপরোয়াভাবে চলাচলকারী মাটি টানার ট্রলির চাপে রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষক মোবাইলে ফোনে বলেন, ফসলি জমি থেকে গত ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি টানা ট্রলির বেপরোয়া চলাচলের কারণে রাস্তার অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।

ময়না ইউনিয়নের খরসূতি গ্রামের খরসূতি মাদ্রাসার উত্তর পাশে বাগান শেখের ফসলি জমিতে পুকুর কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। এছাড়া উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রাম, সাতৈর ইউনিয়নের ভোচনের মাঠ, রামনগর গ্রামের মাঠে সাতৈর ডোবরা পাকা সড়কের পাশে, শেখর ইউনিয়নের বড়গাঁ বিলের ভেতওে, পাঁচা মাগুরা ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটাগুলোতে ও বিভিন্ন জায়গায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নেরই এক বা একাধিক স্থানের ফসলি জমিতে ভেকু দিয়ে অর্থের বিনিময়ে মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছেন মাটিখেকোরা। প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপের অভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন উপজেলার মাটিখেকোরা।

উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি কামরুল সিকদার বলেন, ফরিদপুরের বর্তমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার (পিএএ) স্যার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর উপজেলা পরিষদের হলরুমে প্রশাসন ও পরিষদের আয়োজনে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ইউএনও মোশারেফ হোসাইনের সভাপতিত্বে উপজেলা চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডিসি স্যার বলেছিলেন, কারো এক টুকরো জমিও যেন পতিত পড়ে না থাকে।

এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে জমি পতিত ফেলে না রাখতে বলেন। কিন্তু জমির মালিকেরা টাকার লোভে মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। আর মাটিখেকোরা ফসলি জমির মাটি কিনে ভাটায় বিক্রি করছেন। এ অবস্থা কোনভাবেই কাম্য নয়।

এ ব্যাপারে বোয়ালমারী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কাজী হাসান ফিরোজ বলেন, বেআইনি কাজ বন্ধের দায়িত্ব প্রশাসনের। তিনি এই প্রতিনিধিকে প্রশ্ন রেখে বলেন, বেড়ায় যদি গাছ খেয়ে ফেলে তবে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? তিনি আরো বলেন, অবৈধ কাজ বন্ধের পরিবর্তে প্রশাসন যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে তবে আমরা কি করবো?
এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশারেফ হোসাইন বলেন, ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা বন্ধে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা বন্ধে জনপ্রতিনিধিদেরও একটা ভূমিকা পালন করা উচিত।

উল্লেখ্য, এর আগে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কৃষি জমি কেটে পুকুর খনন করার অপরাধে ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে তৎকালীন ইউএনও মো. রেজাউল করিম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেন। আদালতে বালুবহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এর বিভিন্ন ধারায় সে সময় তিনি বিভিন্ন জনকে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দেন। সেই সাথে অবৈধ কাজে ব্যবহৃত জব্দকৃত ট্রলি এবং ভেকু বিনষ্ট করেন। এসব ঘটনায় সংক্ষুব্ধ মাটিখেকোরা একটি পক্ষের ইন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওই বছরের ৬ ফেব্রয়ারি উপজেলা পরিষদের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে।

ওই ঘটনার পর থেকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফসলি জমির মাটি কর্তন, বিক্রয়কারী এবং অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন মাটিখেকোরা। ভাটামালিকেরাও এ সুযোগে মজুদ বাড়িয়ে গড়ে তুলছেন স্ব স্ব ইটভাটায় মাটির পাহাড়।