নূরুল হক, বিশেষ প্রতিনিধি: দেশের বেশিরভাগ উপজেলা বা থানা সদরে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা অনিশ্চিত। উপজেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতাল আছে-কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসার উপকরণ এখানে নেই বললেই চলে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা শীর্ষ জনপ্রতিনিধিদের কল্যাণে জরুরী উপকরণ এখানে আনা হয়-তবে তা কোন এক অজানা কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাতিলের খাতায় চলে যায়। তবে জনশ্রæতি আছে হাসপাতালে কর্মরত কিছু অসৎ কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের হস্তক্ষেপে সে গুলোকে নাকি অকেজো করে দেয়া হয়। সেটা অকেজো হওয়া বা বাতিলের খাতায় চলে যায় সেটা সাধারণ জনসাধারণের বোধগম্য নয়। তবে কারণতো আছে, সেটা নাইবা বললাম।

যাইহোক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালের অবস্থাটা এমনই যে অতি জরুরী তো দুরের কথা-সামান্য নখের কুনি ভাঙ্গা রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসলেও চিকিৎসা সেবা তো দুরের কথা রোগীকে ভাল করে পরোক্ষ না করেই জেলা সদর, রাজধানী অথবা বড় বড় কোন প্রাইভেট হাসপাতালের দিকে ঠেলে পাঠানো হয়। ওই যে সেই একই কথা-আমাদের এখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার উপকরণ সামগ্রি নেই অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব।

সরেজমিন এবং আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কারণ আমার নিজ উপজেলা দেশের অন্যাতম বৃহত্তম উপজেলা। এটি যশোর জেলার অর্ন্তগত মণিরামপুর উপজেলা। মণিরামপুরের প্রত্যেকটি মানুষ জানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে (হাসপাতাল) অতি জরুরীতো দুরের কথা সামান্য জরুরী কোন রোগী চিকিৎসা জন্য এলেই অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিবেন। চিকিৎসা না হোক অন্তত: প্রাথমিক চিকিৎসা টুকু তারা দিতেই চান না-এটা সবারই জানা। রোগ নির্ণয়ের মতো কোন যন্ত্রপাতি তো দুরের কথা সময়মত ডাক্তারের সন্ধান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কয়েকজন এমবিবিএস (মেডিকেল অফিসার) ডাক্তারের সাথে-সাথে দুই-একজন বিশেষাজ্ঞ ডাক্তার থাকলেও তাদের প্রায় সকলেই জেলা শহর বা অন্য কোন শহরে থাকেন। সেখানে থাকার কারণও আছে। কারণটি হলো কোন নামি-দামী ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালে প্রাইভেট প্রাকটিসের মাধ্যমে অঢেল টাকা কামানো। ফলে নিজ কর্মস্থলে চিকিৎসা সেবা প্রদান বা স্বাভাবিক ভাবে রোগী চিকিৎসা করার মত সময় তারা পান না। যারা থাকেন তাদের অনীহা-নাকি অনভিজ্ঞতার কারণে প্রাথমিক চিকিৎসা টুকুও থেকে বঞ্চিত হয় মফস্বল এলাকার জনসাধারণ গুলো? এটা যে শুধু মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তা কিন্তু নয়। দেশের বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেরও এই একই অবস্থা। অর্থ্যৎ এ সমস্ত অবহেলা আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে মফস্বল বা উপজেলা পর্যায় কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন আছে কি? প্রতি-উত্তরে ১০০% জবাবটা আসবে হাঁ-বোধক। ফলে সঠিক চিকিৎসার জন্য আধুনিক মানের হাসপাতাল যেমনি প্রয়োজন তেমনি সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ চিকিৎসক ও চিকিৎসার আধুনিক উপকরণ সমূহ।
ডাক্তার না হলেও অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যদি একটু মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। কেন উপজেলা সদরে একটি আধুনিক মানের হাসপাতালের প্রয়োজন? একজন রোগীর জন্য ভাল হাসপাতাল নির্বাচনের গুরুত্ব কতখানি? এর জবাবে কিছু উত্তর এমনি-এমনিই এসে যায়। ধরুন কোন একজনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, অথচ সে না জেনে একটি জেনারেল হাসপাতালে চলে গেলে। কিন্তু বাস্তবতা হলো জেনারেল হাসপাতালে এ ধরনের হার্ট অ্যাটাক রোগীর কোন চিকিৎসা নেই। অথচ ওই তার জীবন রক্ষার জন্য তাৎক্ষনিক তাকে এমন একটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে-যেখানে এ রোগের চিকিৎসার মোটামুটি সু-ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ এখানে রোগীর অবস্থা বিবেচনা করলে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য বিলম্বের কারণে রোগীর জীবন চলে যেতে পারে। বিশেষ করে উপজেলা থেকে জেলা শহর বা অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হলে যান বাহনের প্রাপ্যতা, দুরত্ব ও যানজট ইত্যাদি নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। আর এ সময়ের বিড়ম্বনার কারণে ঘটে যেতে পারে বা ঘটে থাকে সেই চরম অঘটন। আর সে-জন্যে আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়ার জন্য উপজেলা পর্যায় সব ধরণের চিকিৎসক ও চিকিৎসার উপকরণের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ আবশ্যক নয় কি?
আবার কিছু-কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। যেমন একজন হঠাৎ অসূস্থ্য হয়ে পড়লো। তো-এ অবস্থা দেখে অনেকে না বুঝেই বলে থাকেন যে-অসূস্থ্য ব্যক্তি স্ট্রোক করেছে। যথারীতি তাকে কাছাকাছি একটি প্রাইভেট হৃদরোগের চিকিৎসা হয় এমন একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। এখানে যদি রোগীর সাথে যারা আছেন তাদের যদি টাকাওয়ালা মনে হয়-তবে তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার না থাকলেও দ্রæত একজন হৃদরোগ বিশেষাজ্ঞ চিকিৎসককে এনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর চিকিৎসা শুরু করে দেন। কিন্তু যদি দেখে মনে হয় এ রোগী বা রোগীর আত্মীয়-সজন তেমন টাকাওয়ালা নয়-তখন চিত্রটা ভিন্ন দিকে রূপ নেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তখন বলে বসেন-এটা তো হার্টের রোগ আপনারা রোগীকে নিউরোসায়েন্স বা অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থাটা এমনই যে, এ রোগী এখানে থাকলে হাসপাতালের ভবন ভেঙ্গে পড়তে পারে যে কোন সময়ে। তাহলে সঠিক পরামর্শ কি হতে পারে? একটু বিশ্লেষণ করা যায়। মুলত: স্ট্রোক মানে এটি হার্টের স্ট্রোকও হতে পারে, আবার মস্তিষ্কের স্ট্রোকও হতে পারে। এক সময় স্ট্রোক বলতে এভাবে শব্দটিকে ব্যবহার করা হতো। তবে এখন শব্দটি কি পরিবর্তন হয়নি? বুঝবার সুবিধার্থে এখন বলে মস্তিষ্কের স্ট্রোক। আর ওটাই হলো হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু স্ট্রোক আর বলি না। এটা শুধু দ্বি-ধা এড়ানেরা জন্য বলে থাকি।
এখন তো আধুনিক যুগ চলে এসেছি। এখন চিকিৎসা কিন্তু একজন ভালো চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করে না। চিকিৎসকতো লাগবেই সাথে লাগবে আধুনিক প্রযুক্তির সেবা। সরকারী হোক আর প্রাইভেট হাসপাতাল হোক-চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের কয়েকটি বিষয়ের উপর নজর রাখা খুবই জরুরী। খুব বড় দৃষ্টিনন্দন ভবন হবে না। সেখানে রোগ নির্ণয়ের মেশিন গুলো আছে কিনা, মেশিনগুলো ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেন এমন টেকনিশিয়ান আছে কি-না। যে বিষয়ে চিকিৎসার প্রয়োজন সে বিষয়ের বিশেষাজ্ঞ চিকিৎসক বা চিকিৎসা বিষয়ে তেমন পরামর্শক রয়েছে কিনা এবং সেখানে সঠিক সেবা প্রদান করা হয় কি-না। এরপর পরেও হাসপাতালটি দুরত্ব এবং খরচের বিষয়টি এখানে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে।
উপজেলা পর্যায়ে এমন একটি হাসপাতাল প্রয়োজন যেখানে শুধু ডায়েরা-কলেরা, আমাশয়, সড়ক দূর্ঘটনায় আহত রোগী, লিভার জনিত রোগরে প্রাথমিক চিকিৎসা, হার্ট অ্যাটাকেরও প্রাথমিক চিকিৎসা হবে, ডায়াবেটিসের চিকিৎসাসহ অন্যান্য রোগ সমূহেরও মোটামুটি চিকিৎসা হবে। সুতরাং এ ধরনেরই হাসপাতালই উপজেলা সদরে স্থাপিত হলেই গ্রামে বা মফস্বল এলাকায় বসবাসরত মানুষ গুলোর সুচিকিৎসার একটা গতি হয়।
উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনায় আনা হলে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে আমুল পরিবর্তন আসবে এবং দেশের মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে। তাহলে উপজেলা বা মফস্বলের মানুষ গুলো অন্তত: কিছুটা হলেও স্বস্থিতে থাকতে পারবে। খুলনার আবু নাসের, ঢাকার পিজি হাসপাতাল, স্কয়ার, ল্যাবএইড, ইউনাইটেড হাসপাতালের মত মাল্টিপাল না হোক-কমপক্ষে সর্ব রোগের চিকিৎসা না হোক, প্রাথমিক চিকিৎিসা বা একটু পরামর্শ পাওয়া এমন একটি হাসপাতাল উপজেলা সদরে হোক এমনটিই প্রত্যাশা। কারণ এখন আধুনিক যুগ, এখন চিকিৎসা শুধু একজন ভাল চিকিৎসকের উপরই শুধু নির্ভর করে না। চিকিৎসার সাথে লাগবে আধুনিক প্রযুক্তির সেবার সাথে মানবীক সেবা ও নিবিড় পরিচর্যা।