সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের’কে স্যার সম্মোধন বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়টা’কে অনেকে অনেক দিক থেকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। তবে এটা জেনে ভালোলাগা কাজ করে যে, আমরা বাংলাদেশের জনগণ শুধুমাত্র আমাদের অধিকারে’র বিষয়ে সোচ্চার।

আমরা মনে করি ‘আরে দেশ তো আমাদের, আমরাই সব, এ সব কিছু আমাদের অধিকার’। কিন্তু এই অধিকারে’র পাশাপাশি যদি আমরা আমাদের ডিউটি ও এই রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের কন্ট্রিবিউশন টা’কে সর্বপ্রথম প্রাধান্য দিতাম, তাহলে হয়ত আজকে এমন প্রশ্নই উঠতো না। তবে আমি মনে করি যে, এমন ধরণের প্রশ্ন জনসাধারণের মাঝে উত্থাপিত হলে সেই প্রশ্নের উত্তরটা কেমন হওয়া উচিত এবিষয়ে বিস্তর গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা’র প্রয়োজন রয়েছে।

অনেকে’র মতে, সংবিধান মোতাবেক এই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, আর সরকারি কর্মচারীগণ যেহেতু জনগণের অধীন, সেহেতু তাদেরকে স্যার সম্মোধন করার প্রয়োজনীয়তা বা বাধ্যবাধকতা নেই। উল্টো তাদেরই উচিত জনগণ’কে স্যার বলে সম্মোধন করা।

হ্যাঁ এটা ঠিক যে বাধ্যবাধকতা নেই, তবে আমি জনসাধারণের মনে জাগ্রত এমন চেতনার মোটেও সাধুবাদ জানাতে পারছি না। কারণ এখানে বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে আমাদেরকে পর্যালোচনা করা উচিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর ৭ নং অনুচ্ছেদে (১ দফায়) সংবিধানের প্রাধান্য অংশানুযায়ী , ”প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; কথাটা যদি এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধতা পেতো তাহলে সেটা ছিলো ভিন্ন কথা কিন্তু এই অনুচ্ছেদে একই লাইনের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, “এবং জনগণের পক্ষেই সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বেই কার্যকর হইবে”।

তার মানে আমরা এখানে স্পষ্টভাবে ধারণা পাচ্ছি যে, জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক হওয়া সত্বেও সেই ক্ষমতা কেবল মাত্র জনগণের পক্ষে প্রয়োগ এবং সংবিধানে’র অধীনস্থ হবে। পুরো অনুচ্ছেদটি’তে পরোক্ষভাবে জনগনকে সকল ক্ষমতার মালিক করা হলেও সকল ক্ষমতার প্রয়োগ হবে শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্রের কার্মে নিযুক্ত প্রতিনিধিগণের দ্বারা। এই ক্ষমতা প্রয়োগ সকল সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী গণের উপর ন্যস্ত থাকে।

তারা তাদের মেধা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচেতনার দ্বারা জনগণের সেবা ও কল্যানার্থে জনগণের দেয়া ক্ষমতা’র প্রয়োগ করে থাকেন । প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে সকল সময়ে জনগণের সেবা করবার চেষ্টা করা( সংবিধান. অনুচ্ছেদ-২১, দ-২)। এই অনুচ্ছেদানুযায়ী, জনগণের সেবা করবার চেষ্টা করা সরকারি কর্মচারীদে’র কর্তব্য। এটা তাদের ডিউটি। কিন্তু এই সেবা করবার চেষ্টা করা কথাটার দ্বারা তাদের সত্যিকার অর্থে সেবাদানের বাধ্যবাধকতাকে দূর্বলভাবে প্রকাশ করা হয়েছে কি হয় নি এটা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে ।

সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী’দের বেতন-ভাতা দেয়া হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে। ট্যাক্স প্রদান করা সকল জনগণের দ্বায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পরে। ট্যাক্স প্রদান এমন একটি পদ্ধতি যেখানে শুধুমাত্র জনগণ এটি প্রদান করতে বাধ্য নয় বরংচ সেই সাথে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকগণই এটি প্রদান করতে বাধ্য। এ থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীগণও এই ট্যাক্স প্রদান করে থাকেন।

যেকোনো পণ্যসামগ্রী ক্রয়ে ট্যাক্স প্রদান বা তাদের আয়ের উপরেও তাদেরকে আয়কর প্রদান করতে হচ্ছে। যেহেতু সকল জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এবং তাদের নিজেদেরও ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা হচ্ছে সেহেতু তাদেরকে জনগণের চাকর ভাবার কিছু নেই।

কেননা অর্থগত দিক থেকে তাদেরকে জনগণের চাকর মনে হলেও সংবিধান কোথাও এই বিষয়টিকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে চাকর শব্দটিকে ব্যবহার করে নি। এই শব্দটা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে আগত। এই শব্দটাকে বর্জন করা অতিব জরুরি বলে আমি এই মুহুর্তে মনে করছি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাদেরকে ( সরকারী কর্মচারীগণ ) স্যার সম্মোধনে জনগণের কোনো বাধ্যবাধকতা রয়েছে কি না। উত্তরে বলব, স্যার শব্দটি হচ্ছে সম্মান সূচক একটি শব্দ। একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিকে সম্মান পূর্বক জনগণ স্যার সম্মোধন করবেন কি করবেন না এটার কোনো বাধ্যবাধকাতা কোনো আইনে বলা নেই। জনগণকে স্যার সম্মোধনে বাধ্য করার এখতিয়ারও কোনো কর্মকর্তা কর্মচারী’র নেই। জোর পূর্বক স্যার সম্মোধণে বাধ্য করাটা অন্যায়। জনগণ এটাতে বাধ্য নয়। কিন্তু আমি এই মুহুর্তে মনে করছি যে, তাদেরকে সম্মান করা প্রতিটা মানুষের নৈতিক দ্বায়িত্ব হওয়া উচিত, কেননা একে তো কথায় আছে সন্মান দিলে সন্মান পাওয়া যায়। ”গিভ এন্ড টেক” এমন মননশীলতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত তারা তাদের পরিশ্রম ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহসিকতার সাথে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেছে। তাই আমি বলব, তাদের সস্মান করা আমাদের নৈতিক দ্বায়িত্বে থাকা উচিত। এখানে বাধ্যবাধকতা নেই।

আরেকটি শব্দ বার বারই এসব বিতর্কের সাথে জড়িত হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘চাকর’ শব্দটি। আমি মনে করি যে, চাকর শব্দটিকে জনগণের মস্তিষ্ক থেকে বর্জন করা উচিত। একটি রাষ্ট্র সকল মানুষের উন্নত চেষ্টা, পরিশ্রম ও কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে এগিয়ে যায়। সেখানে সরকারি কর্মচারীগণ কে জনগণের চাকর হিসাবে গণ্য করাটা কোনো মানুষের নীতিনৈতিকতা’র অন্তর্ভুক্ত না হলেই ভালো হবে।

লেখা: সৌরভ গাঙ্গুঁলী
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।