সাল ২০১০। জারাগোজার সাথে অ্যাওয়ে ম্যাচ। লিগ রেসে রিয়াল-বার্সা তখন জমজমাট। ম্যাচের ৭০ মিনিট, রিয়াল ১-০ তে পিছিয়ে। মাঠে নামলেন কাকা। চোট থেকে ফিরে প্রথম ম্যাচ। এক গোলে অ্যাসিস্ট করলেন, আর ৬ মিনিট বাকি থাকতে করলেন জয়সূচক গোলটি। পরদিন মার্কা রিপোর্ট করল, “যিশুর মতোই পুনর্জন্ম”। কিন্তু সেটি ছিল কেবলই ইনজুরি থেকে কাকার ফিরে আসার লম্বা মহাকাব্যের প্রথম অধ্যায়।

যখন কাকা মাদ্রিদে এলেন, তখন বিশ্বের সেরা তিন খেলোয়াড়ের একজন তিনি। মেসি-রোনালদো যুগ মাত্রই শুরু হচ্ছে, তিনি তখনও বিশ্বসেরাদের একজন। সিরি-আ’র ধূসর প্রান্তরে ফুল ফুটিয়ে এলেন রিয়ালে। সেবার জাবি আলোনসো, বেনজেমাসহ রোনালদোও এলেন রিয়ালে। CrisKa জুটির মাদ্রিদে সৌরভ ছড়ানোর অপেক্ষায় ফুটবলমোদীরা। কিন্তু তার পরের অধ্যায় কেবলই এক মহানায়কের স্বর্গ হতে পতনের। আজ পিছন ফিরে দেখে নেওয়া যাক, ঠিক কী কী কারণে মাদ্রিদে কাকা সফল হতে পারেননি।

সাবেক বিশ্বসেরা খেলোয়াড় রিকার্ডো কাকা; Image Source: maxresdefault

ইনজুরি ও বিশ্বকাপ স্বপ্ন

কাকার নিজের বক্তব্যেই বলেছেন, তার অসফলতার মূল কারণ ছিল চোট। কাকা যখন মাদ্রিদে আসেন, তার আগের মৌসুমেও চোট-জর্জরিত ছিলেন। হিপ ইনজুরিতে পড়ে মিস করেন বেশ কিছু ম্যাচ। আবার দুঙ্গার ব্রাজিলের মূল খেলোয়াড় হিসেবে তাকে কেন্দ্র করে দল গড়ায় জাতীয় দলের প্রায় সব ম্যাচেই তাকে দলে রাখা হতো। ফলে রিয়ালে প্রথম মৌসুমে হিপ ইনজুরি তাকে বেশ ভোগায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রথম মৌসুমে পেল্লেগ্রিনির অধীনে ততটা বাজেও খেলেননি কাকা। রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান এডেন আজারের সাথে তুলনা করলে তার প্রথম মৌসুম অনেকগুণ ভালোই ছিল বলতে হবে।

বাদ সাধে বাম পায়ের চোট। আদর্শ অবস্থায় কাকার ২০১০ বিশ্বকাপে খেলার কথা নয়। কিন্তু সাধারণত লাতিন খেলোয়াড়দের জাতীয় দলের প্রতি টান অজানা কিছু নয়। ব্রাজিলের হয়ে দায়িত্ব পালনে কাকা বিশ্বকাপ খেলেন। পাঠক মনে করে দেখতে পারেন, হল্যান্ডের সাথে ম্যাচ হারার পর কাকা মাঠ ছাড়ছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এরপর পায়ের চোট বিশালাকার ধারণ করে। আট মাস মাঠের বাইরে থেকে যখন ফেরেন, ততদিনে মাদ্রিদের চেয়ারে মরিনহো!

ওজিলের উত্থান ও মরিনহো

২০১০-১১ মৌসুমে মাদ্রিদে আসেন ওজিল, খেদিরা, ডি মারিয়া। পেপ গার্দিওলার বার্সা তখন দুরন্ত। লিগ কিংবা কাপ – কোথাও পা হড়কানোর কোনো সুযোগ নেই। এরই ধারাবাহিকতায় মরিনহোর নিজের চাহিদায় আনা ডি মারিয়া-ওজিল মাদ্রিদের জার্সিতে নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে থাকে। ফলে কাকা যখন আট মাস পরে ফেরেন, তখন তার পক্ষে মূল একাদশে সুযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর কারণ হিসেবে মরিনহোকে দোষারোপ করার আগে কিছু বাস্তবতাও দেখে নেয়া যাক।

মরিনহোর ৪-২-৩-১ ফর্মেশনের লেফট উইংয়ে ছিলেন রোনালদো, স্ট্রাইকিংয়ে বেনজেমা। বাকি দুই পজিশন অ্যাটাকিং মিডে ওজিল আর রাইট উইংয়ে ডি মারিয়া। সমস্যা দাঁড়ালো যেখানে, কাকা মূলত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার যেখানে ওজিল মোটামুটি দলকে একাই চালিয়ে যাচ্ছেন দারুণভাবে। আর রাইটে মরিনহোর চাওয়া ছিল পরিশ্রমী খেলোয়াড়। আমরা জানি, ডি মারিয়াকে তার ওয়ার্করেটের জন্য ‘থ্রি লাংস’ বলা হয়। আবার স্ট্রাইকার হিসেবে বেনজেমা ও হিগুয়াইনের মধ্যে যিনিই মাঠে নামেন, তিনিই গোল করেন। ফলে ডি মারিয়াকে না খেলালে মরিনহো রাইট উইংয়ে হিগুয়াইনকে খেলাতেন। ফলে ট্যাকটিক্যালি কাকার মূল একাদশে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে গেল। একই সাথে চোটের কারণে তরুণ হিগুয়াইন-ডি মারিয়াদের মতো অফ দ্য বল পরিশ্রম করতে পারতেন না, যা ছিল মরিনহোর প্রথম চাওয়া।

মরিনহোর সাথে কাকা; Image Source: goal.com

তবে কি মরিনহোর দোষ ছিল না? অবশ্যই ছিল। কাকা নিজেও সেটা বলেছেন,

“এক পর্যায়ে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিও হয়। আমার মতে আমার খেলা উচিত ছিল, আর তিনি ভাবতেন উচিত নয়! কিন্তু এগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে ছিল। আমি কখনো বিদ্রোহ করিনি, বলিনি আমি ক্লাব ছেড়ে দেব। আমি বলতাম, এটা আপনার পছন্দ, তবে আমার দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া উচিত। তার বলার কিছু ছিল না। তিনি ওজিলের জায়গা আমাকে দিতে নারাজ ছিলেন। আর মরিনহোকে আপনারা যেমন দেখেন, তিনি তেমনই। স্মার্ট কোচ, নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আমি অন্যথা ভাবলেও দল ভাল করছিল। পেপের বার্সাকে হারিয়ে লিগ-কোপা দেল রে জিতেছিল, উঠেছিল টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে।”

২০১১-১২ সালে কেবল পরিশ্রম করে খেলতে পারে এমন চাহিদার জন্য কাকাকে বসিয়ে রেখে অখ্যাত কালেহনরে খেলাতেন, যার সপক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু ঐ যে ফুটবলে একটা আপ্তবাক্য আছে, ‘বিজয়ীর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগে না’! ঠিক সেই মতোই মরিনহোর লিগ জয় আর চ্যাম্পিয়নস লিগে ভালো ফল কাকাকে বেঞ্চ করার কথা ভুলিয়ে দেয়। এটি হয়ে পড়ে বিস্মৃত এক ইস্যু।

বিশাল দামের বোঝা

বর্তমান বাজারে ৮০ মিলিয়ন ইউরোকে তেমন কিছু মনে না হলেও কাকাকে যখন কেনা হয়, তখন সেটা ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ দুইটি ফি’র একটা। সমর্থক হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকরা কিঞ্চিৎ অধৈর্য হয়ে পড়েন। একদিকে পেপ গার্দিওলার বার্সার সর্বজয়ী অগ্রযাত্রা, আর অন্যদিকে রোনালদোর শুরু থেকেই গোলের পর গোল। তাই সহজাতভাবেই কাকার উপরও চাপ ছিল একই রকম পারফর্ম করার। চোট কিংবা অন্য সমস্যা মানতে নারাজ সমর্থকরা। এটা ছিল লা লিগায় নবাগত কাকার জন্য দারুণ বোঝা। আবার ৩০-৪০ মিলিয়ন ইউরো রেঞ্জে কেনা ডি মারিয়া-ওজিলের জন্য পারফর্ম করার দারুণ চাপটা শুরু থেকেই ছিল না। তাই তারা সহজেই নিজেদের মেলে ধরতে পেরেছেন।

যে জুটিটি কখনো জ্বলে উঠতে পারেনি; Image Source: Twitter

পজিশন

ফুটবলে একজন খেলোয়াড়ের ঠিকভাবে উত্থানের জন্য দরকার তার মনমতো জায়গায় খেলানো। কাকা মিলানে ছিলেন মূল খেলোয়াড়। ২০০৬-২০১০ পর্যন্ত ব্রাজিলেও তিনিই মূল খেলোয়াড়। দুই দলেই সব পরিকল্পনা তাকে ঘিরেই হতো। আনচেলোত্তির ৪-৩-১-২ ফরমেশনের ‘ট্রেকোয়ার্টিস্তা রোল’ ছিল তার, অর্থাৎ ফর্মেশনের দুই স্ট্রাইকারের পেছনের মূল প্লেমেকারের রোল ছিল তার।

রিয়াল মাদ্রিদে এসে কাকা আর দলের মূল খেলোয়াড় নন; রোনালদো, ওজিল, বেনজেমাদের মাঝে তিনি আর একজন তারকামাত্র। তার পছন্দসই ফর্মেশনে না খেলাতেন পেল্লেগ্রিনি, না মরিনহো। এরই মাঝে চোটের কারণে তার ফর্মও আর আগের মতো ছিল না, যার দরুণ তার জন্য দলের সেটআপ পরিবর্তন করা যায়। ফলে ফুটবলীয় দৃষ্টিতেও রিয়াল মাদ্রিদে কাকার সময়টা কঠিন হওয়ারই ছিল।

পেনাল্টি মিসের খেসারত ও মদরিচের আগমন

লা ডেসিমা জয়ের জন্য রিয়াল মাদ্রিদ ততদিনে মরিয়া। জোসে মরিনহোর অধীনে ছুটছে দল। ২০১১-১২ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বায়ার্ন মিউনিখের দ্বিতীয় লেগের খেলা টাইব্রেকারে গড়ায়। পেনাল্টিকে মাথায় রেখে অতিরিক্ত সময়ে মরিনহো কাকাকে মাঠে নামান। সেই সময়ে ব্রাজিলের মূল পেনাল্টি টেকার কাকা। এসি মিলানে থাকতেও তিনিই নিতেন। পেনাল্টি সফলতার দিক থেকে বিশ্বসেরাদের একজন কাকা সেই মহামুহূর্তে পেনাল্টি মিস করলেন। তিনি একাই করেননি, সাথে রোনালদো-রামোসও করেছিলেন। কিন্তু রোনালদোর পিঠে ভর করে রিয়াল মাদ্রিদ পেপ গার্দিওলার বার্সাকে হারিয়ে লিগ জেতার দ্বারপ্রান্তে, যার মধ্যে রামোসেরও দারুণ ভূমিকা। ফলে সমর্থকদের রাগ গিয়ে পড়ল কাকার উপর। এর পরের ট্রান্সফার মার্কেটে রিয়াল মাদ্রিদ কিনে আনে টটেনহ্যাম হটস্পারের প্লেমেকার লুকা মদরিচকে। পরিষ্কার হয়ে যায়, কাকার আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই মাদ্রিদে।

এরপর এসি মিলানে ফিরে গেলেও তিনি ছিলেন কেবল নিজের ছায়া হয়ে;Image Source: Wallpaper Access

এরপর রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসি মিলান হয়ে অরল্যান্ডো সিটি – কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় নি সেই আগের কাকাকে। ২০১০-এর ব্যর্থতার পর মানো মেনেজেসের ব্রাজিল দলেও ব্রাত্য। বিশ্ব দেখল এক ফুটবল মহাতারকার আকস্মিক পতনের।

পতন নাকি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি?

মেডিকেল সায়েন্সের অভূতপূর্ব উন্নতি ও রোনালদো কিংবা লুকা মদরিচদের হালের অসামান্য ফিটনেস আমাদের নিকট অতীতও ভুলিয়ে দিচ্ছে। অনেক তারকা ফুটবলারকেই দেখা যেত, আগে তার মূল সাফল্যের সময় ৫-৬ বছর স্থায়ী হতো। গড়পড়তা ইউরোপীয়দের আরেকটু বেশি হলেও লাতিন আমেরিকান কিংবা আগের ব্রাজিলিয়ানদের ক্ষেত্রে তা ৩০ পার হবার আগেই তারকারা তাদের সেরা সময় পেরিয়ে যেতেন। রোনালদিনহো, আদ্রিয়ানো, রবিনহো, কাকা – তালিকা লম্বা হতেই থাকে। কিন্তু ২০০৪-২০০৯ সালে কাকা যে সৌরভ ছড়িয়েছেন, তা ফুটবল ইতিহাসেই অনবদ্য, অবিস্মরণীয়। এ সময়টাকে অসফল বলা যেকোনো মানদণ্ডেই অসমীচীন।

২০০৯ কনফেডারেশন কাপের সেরা খেলোয়াড় কাকা; Image Source: Eurosports

ব্রাজিল ফুটবলের ব্যাপারে বরাবরই নাক-উঁচু। বিশ্বকাপ জয় বাদে কোনো খেলোয়াড়কেই তারা সেভাবে মনে রাখে না। কিন্তু ২০০৬-২০১০ ব্রাজিলের সেই ঊষর সময়ে, প্রতিভার অভাবের সময়ে কাকা-রবিনহোর পিঠে চড়ে ব্রাজিল কোপা আমেরিকা-কনফেডারেশনস কাপ জয় করে, পায় বাছাইয়ের শীর্ষ স্থান। কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের সাথে প্রথমার্ধেও সঠিক পথেই ছিল ব্রাজিল। এরপর স্নাইডার ঝড়ে এলোমেলো ব্রাজিল। শেষদিকে কাকার বাঁকানো শট যখন নেদারল্যান্ডসের গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দেন অবিশ্বাস্য দক্ষতায়, তখনই বিদায় ঘন্টা বেজে যায় ব্রাজিলের। উদগত আবেগকে চেপে রেখে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে থাকেন কাকা।

সেই সাথে যেন এক মহাকাব্যের সমাপ্তি। এরপর চোট সারাতে ছুরির নিচে, আর তারপর আট মাসের জন্য মাঠের বাইরে। আদতে যেন ফুটবল বিশ্বের দৃশ্যপটের বাইরেই চলে যান। কিন্তু এরপরও কি ব্রাজিল কিংবা ফুটবল ভক্তরা কি মনে রাখবে না এক মহাতারকাকে, যিনি দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর জন্য ক্যারিয়ার ধ্বংস হতে পারে জেনেও চোট নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, এবং যার চূড়ান্ত ফলাফল ছিল স্বর্গপতন?