দেশে আরও কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক * নামে-বেনামে তিন লাইটারেজ জাহাজ, পঞ্চগড়ে চা বাগান, গাজীপুর ও থানচিতে রিসোর্ট ও টেক্সটাইল মিলের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে * ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আগেই বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে * আমেরিকা, কানাডা, দুবাইয়ের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে বিএফআইইউর চিঠি

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। গুলশানের র‌্যাংকন আইকন টাওয়ারের বাসায়ও নেই তারা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসেও যাতায়াত নেই। দুদকের তলবি নোটিশও সরাসরি তাদের হাতে পৌঁছাতে পারেনি অনুসন্ধান টিম। নোটিশ দেওয়া হয়েছে তার অফিসে কর্মরত এক কর্মীর হাতে। এ অবস্থায় তাদের অবস্থান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। তারা এখন কোথায় আছে-তা নিশ্চিত করতে পারছেন না দুদক কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ। তাদের এ ‘আত্মগোপন’ রহস্যের সৃষ্টি করছে। তার ঘনিষ্ঠদের দাবি, স্ত্রীর চিকিৎসাজনিত কারণে পরিবার নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন বেনজীর। তবে তার দেশত্যাগের বিষয়টি সরকারি কোনো সূত্র নিশ্চিত করেনি। পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, তিনি দেশেই আছেন। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে পরিবারের কেউ প্রকাশ্যে আসছেন না। ৬ ও ৯ জুন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের দুদকে হাজিরার দিন ধার্য আছে। আর বেনজীর পরিবারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।

দেশ-বিদেশে বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তাদের বিস্ময় বাড়ছে। নতুন করে তার নামে-বেনামে আরও কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। স্ত্রী-সন্তানদের পাশাপাশি শাশুড়ি ও স্বজনদের নামেও তিনি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নতুন করে যেসব সম্পদের তথ্য দুদকের হাতে এসেছে তার মধ্যে আছে-অন্তত তিনটি লাইটারেজ জাহাজ, পঞ্চগড়ে বিশাল চা বাগান, বাংলাবান্ধা পোর্ট এলাকায় জায়গাজমি, গাজীপুর এবং থানচিতে রিসোর্ট ও গাজীপুরে একটি টেক্সটাইল মিল। এসব সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মালিকানায় বেনজীর পরিবারের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হওয়ার পরই পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের বিদেশে সম্পদ আছে কিনা তা জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে আমেরিকা, কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুবাইয়ের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই তিনটি দেশে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের কোনো ব্যাংক হিসাব, নিবন্ধিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে কিনা-তা জানাতে বলা হয়েছে চিঠিতে। আর দেশের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার আগেই অন্তত বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন বেনজীর। সরিয়ে নেওয়া টাকার অঙ্ক অন্তত ১০০ কোটি বলে জানা গেছে। দুদকও অ্যাকাউন্ট থেকে তার টাকা সরানোর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) বহুরুল হক বলেন, আইন ও বিধি অনুসারে যা যা করা দরকার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেনজীর পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর বিপুল সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি হিসাব ফ্রিজ করার আগেই টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কত টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন তা অনুসন্ধান কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখবেন। তিনি আরও বলেন, ‘অনুসন্ধান কর্মকর্তা আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করছেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করে আমাদের টিম কাজ করছে। অল্প সময়ে আমরা অনেক এগিয়েছি।’ ২৬ ও ২৭ মে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক ও ফ্রিজ করেন আদালত।

জানা গেছে, ১৮ এপ্রিল কমিশন সভায় বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর থেকেই অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় বেনজীর ও তার পরিবার। বিশেষ করে তিন দফায় আদালতের মাধ্যমে বেনজীর, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে থাকা প্রায় হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার খবর গণমাধ্যমে ঝড় তোলার পর তাদের কোথাও আর দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার বিকালে গুলশানের র‌্যাংকন আইকন টাওয়ারে গিয়ে খোঁজ করা হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই বেনজীর পরিবারের কাউকে ওই বাসায় দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ জয়নাল।

তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই স্যারের পরিবারের কাউকে বাসায় ঢুকতে কিংবা বের হতে দেখিনি। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ৪-৫ জন পুলিশ সদস্য এখানে এসেছিলেন। তারা নিচে কিছুক্ষণ অবস্থান করে চলে যান।’ ১৪ তলা র‌্যাংকন আইকন টাওয়ারের ১০ থেকে ১৪ তলার চারটি অ্যাপার্টমেন্ট বেনজীর তার স্ত্রী ও এক সন্তানের নামে কিনে সেখানে বসবাস করেন।

বেনজীর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, বেনজীরের স্ত্রী জিসান মির্জা অসুস্থ। ১২ এপ্রিল স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। এরপর আর দেশে ফেরেননি। বর্তমানে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। দুবাইয়ের অভিজাত এলাকা হিসাবে খ্যাত পাম জুমেরা ও মেরিনা এলাকায় একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বেনজীর পরিবারের। তবে দুবাই ও দেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো সূত্রই তাদের সেখানে অবস্থানের খবর নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, বেনজীর দেশেই আছেন। ৬ জুন তার দুদকের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতিও রয়েছে। তিনি নিজে হাজির হবেন নাকি-আইনজীবীর মাধ্যমে তার বক্তব্য উপস্থাপন করবেন তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুদক বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার পরই তিনি তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্তত ২৫টি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছেন। দুদকের অনুসন্ধান দলও এই তথ্যের সত্যতা পেয়েছে। এছাড়া বেনজীর পরিবারের পঞ্চগড়ে বিশাল চা বাগান থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে দুদক। শিগগিরই এ সম্পত্তি ক্রোক করতে আদালতে আবেদন করা হবে। নতুন করে খোঁজ পাওয়া অন্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে-পার্বত্য এলাকা বান্দরবানের থানচিতে নয়নাভিরাম রিসোর্ট, গাজীপুরে আরেকটি রিসোর্ট, গাজীপুরে একটি টেক্সটাইল কারখানা ও ৩-৪টি লাইটারেজ জাহাজ। এই জাহাজগুলো দেশের একটি নামি কোম্পানির ব্যানারে চলাচল করে। বেনামে থাকলেও এসব জাহাজের মালিকানা বেনজীর পরিবারের। এসব তথ্য নিশ্চিত হতে বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি দিয়ে দলিলাদি সংগ্রহ করা হচ্ছে।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, বেনজীরের অবস্থান নিয়ে যখন ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে তখন তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক। আবেদনে তিনি বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিদেশ গমনে এখনো নিষেধাজ্ঞা চায়নি দুদক। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে অচিরেই বেনজীর আহমেদের বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে দুদকের প্রতি আহ্বান জানান এই আইনজীবী। সম্প্রতি বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও সম্পদের পাহাড় নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। এরপর তার সম্পদের খোঁজ নিতে দুদককে চিঠি দেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। এরপরই তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়।

সিটিজেন টিভির মালিকানা ছিনিয়ে নেয় বেনজীর : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি বলেছেন, তিনি সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান। তার কাছ থেকে টিভির মালিকানার অংশ জোর করে কেড়ে নেন বেনজীর ও নাফিস। শুরুতে সিটিজেন টিভির কোনো শেয়ারহোল্ডার ছিল না। টাকার অভাবে আমি টিভিটি অনএয়ারে যেতে পারছিলাম না। তখন আমার দূরসম্পর্কের কাজিন রাজ্জাকুল হোসেন টুটুল তাকে সঙ্গে নেওয়ার অনুরোধ করেন। তাকে সঙ্গে নেওয়ার পর থেকেই তিনি গড়িমসি শুরু করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। এর মধ্যে আমি সম্প্রচারে যাওয়ার জন্য সরকারের সব অনুমোদন নিয়ে নিই। এ অবস্থায় হঠাৎ এক গভীর রাতে এক যুবক আমার বনানীর বাড়িতে আসে। সে সিটিজেন টিভি স্পোর্টস দিয়ে শুরু করার কথা বলে আমাকে তুলে বেনজীরের বাসায় নিয়ে যায়। বেনজীর তখন র‌্যাব ডিজি। সেখানে বেনজীর, নাফিজ, টুটুল ছাড়াও অচেনা চেহারার অস্বাভাবিক দুজন লোক ছিল। যাদের দেখে সশস্ত্র মনে হয়েছে। সেখানে বেনজীর একটা হলুদ কাগজ আমার হাতে দিয়ে সই করতে বলেন। আমি কাগজের লেখা পড়তে শুরু করলে বেনজীর বাধা দিয়ে বলেন সিটিজেন টিভি হবে স্পোর্টস ওরিয়েন্টেড। অচেনা দুজনকে স্পোর্টসের লোক হিসাবে পরিচয় করিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে বলেন। হলুদ কাগজে সেই চুক্তিপত্র। এক পর্যায়ে ধমকের সুরে তারা আমার সঙ্গে কথা বলে। তখন আমি ওই কাগজে সই দিতে বাধ্য হই। এরপর জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমার নামে ৩০ শতাংশ শেয়ার দিয়ে আমাকে চেয়ারম্যান রাখা হয়েছে। বেনজীরের দুই মেয়ের নামে ১৫ শতাংশ করে মোট ৩০ শতাংশ, নাফিজ শরাফত ২৫ শতাংশ শেয়ার নিয়ে (এমডি হয়েছেন) আর টুটুল ১৫ শতাংশ শেয়ার নিয়ে হয়েছেন পরিচালক। এ অবস্থায় ৪-৫ বছর চলে গেলেও আমি আর কিছু করতে পারিনি। আইনি বাধায় তারা আমাকে বাদ দিয়েও টেলিভিশনটি চালু করতে পারেনি।

সূত্র: যুগান্তর