বর্ষাকাল মানেই নৌকা ভ্রমণের ধুম। বর্ষাকাল মানেই ক্লান্তিহীন নৌকা ভ্রমণ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষার বন্দনা করেছেন এভাবে, ‘এই শ্রাবণ-বেলা বাদল-ঝরা/ যূথীবনের গন্ধে ভরা/…বাদল-সাঁঝের আঁধার-মাঝে/ গান গাবে প্রাণ-পাগল-করা।’

বর্ষায় নদী তার যৌবন ফিরে পায়। নিজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে কুণ্ঠাবোধ করে না। প্রকৃতিও সাজে অপরূপ সাজে। কদম, কেয়া প্রকৃতিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে। সুনির্মল আকাশে পেঁজা মেঘ মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়ায়।

হালকা বাতাসে নদীতে শান্ত ঢেউ ওঠে। নদীর দু-পারে চিরসবুজের সমারোহ। বৃক্ষে বর্ষার বৃষ্টি নব্যতা দান করে। এ রকম পরিবেশে নদীতে ঘুরতে কার না ভাল লাগে। বাংলাদেশে অসংখ্য নদ-নদীর অবস্থানের কারনে বাংলাদেশ নামটির সাথে বিশেষণ হিসেবে নদীমাতৃক শব্দটি যুক্ত করা হয়। প্রায় ৭০০ নদ-নদী বাংলাদেশের মধ্যে বটমূলের ন্যায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে বড়াল ও গোহালা অন্যতম দুটি নদী।

নদী দুটি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবস্থিত। এই দুটি নদীর তীরেই ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি। কবি বজ্রা নিয়ে এই নদীপথেই তাঁর জমিদারি দেখাশোনা করতেন। কবি শাহজাদপুরে অবস্থানককালে অসংখ্য কবিতা, ছোট গল্প এবং গান লিখেছেন। ‘সোনারতরী’ কাব্যের বৈষ্ণব কবিতা, ভরা ভাদরে, দুই পাখি, ‘চিত্রা’ কাব্যের চিত্রা, নগর সঙ্গীত প্রভৃতি। এছাড়াও ছোটগল্পের মধ্যে পোস্টমাস্টার, ছুটি, সমাপ্তি এবং গানের তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা,ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে উল্লেখযোগ্য। কবির স্মৃতিবিজড়িত বড়াল ও গোহালা নদীতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ১ম ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে নৌকা ভ্রমণ সম্পন্ন হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ভ্রমণ সম্পর্কিত অনুভূতি তুলে ধরছি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সাংবাদিক মোঃ হাবিবুর রহমান।

মোঃ নাছরুল হক

এটাই আমার জীবনের প্রথম ভ্রমণ। পূর্বে নদীপথে বের হয়নি কখনো। আমি সত্যিই অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। আমি যখন নৌকা পথে যাচ্ছিলাম, আমার ভেতরে অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। যানজট, কোলাহল মুক্ত পরিবেশ, স্নিগ্ধ বাতাস, চারপাশের প্রকৃতি আমাকে উৎফুল্লতা দান করেছিল। অভিজ্ঞতা হয়েছে নদীর সাথে কিভাবে মানুষ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে তা দেখার। জেলেদের জীবন কতটা সংগ্রামের তার কিছুটা বাস্তবতা খুঁজে পেয়েছি এই নদীপথে।

মোহসিনা আহমেদ স্নিগ্ধা বলেন,

প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে দারুণ একটা নৌকা ভ্রমণের স্বাদ পেয়েছি। আমি স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতির খুব নিকটে আসতে পেরে আমার উৎফুল্লতা বেড়েছিল সহস্রগুন । আমি একদম প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়েছিলাম। আমি আমার ছোটবেলার পড়া “আমাদের ছোট নদী” কবিতাটার মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম বড়াল ও গোহালা নদীর সাথে। আমি মুগ্ধ হয়ে আঁকাবাঁকা নদীটা দেখছিলাম। উপভোগ করছিলাম নদীর তীরে বাচ্চাদের আনন্দ করে গোসল এবং সাঁতারকাটা। রবীন্দ্রনাথ এর কবিতায় যেমনটা বলেছিলেন। নদী দেখে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথ যেন এই নদী টা দেখেই “আমাদের ছোট নদী” কবিতাটা লিখেছিলেন। সব মিলিয়ে আমি বন্ধুদের সাথে বেশি আনন্দ উপভোগ করার চেয়ে প্রকৃতিকে অনেক বেশি উপভোগ করেছি। তাই আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে এই ভ্রমনটা। সিনিয়র জুনিয়র এর মেলবন্ধন হয়েছে। নৌকা ভ্রমন টা আমার স্বার্থক হয়েছে।

শাওন সরকার

প্রায় আট ঘণ্টার ভ্রমণটা ছিল খুবই উপভোগ্য। অনেক দিন পর সবার সঙ্গে এমন একটি অবসর সত্যিই প্রশান্তি এনে দেয় মনের মধ্যে। আমাদের সঙ্গে জুনিয়রদের অংশগ্রহণ করা এবং তাদের সাবলীল আচরণ প্রশংসনীয়। এই যান্ত্রিক জিবনে নদী পথে ভ্রমণ প্রকৃৃতির অপার লীলা স্পর্শ করার সুযোগ করে দেয়। একমুহূর্তের জন্য হলেও সকল ক্লান্তি-ক্লেশ ভুলে থেকে বাংলার জল, বাতাসের সঙ্গী হতে পেরে অনেক ভালো লেগেছে। যাত্রা পথে খাবার খাওয়া, গান-বাজনা পরিবেশনা সর্বোপরি এক বুক বিশুদ্ধ শ্বাস নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা অসাধারণ ছিল।

জাহিদ হাসান

বিশ্ববিদ্যালয় মানেই জুনিয়র-সিনিয়রের অনন্ত ভালবাসার বাঁধন। সবাই মিলেমিশে থাকা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে কোনো ডিপার্টমেন্ট তাদের সব জুনিয়রদের নিয়ে এভাবে নৌকা ভ্রমণে যায়নি। সেখানে আমরা এক অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। খুবই সুন্দর একটা দিন পার করেছি। ভ্রমণকালে নৌকা যখন আঁকাবাঁকা বড়াল নদীটি অতিক্রম করছিল, আমি খুব মনোযোগ সহকারে নদীর তীরে গ্রাম্যবধুদের মাটির কলসে পানি নিয়ে যাওয়া দেখছিলাম। কেউ কেউ গরুকে গোসল করাচ্ছিল। সব দৃশ্যগুলো কবির কবিতার সাথে অতপ্রতভাবে জড়িত। সত্যিই এত আড্ডা, আনন্দ, শিক্ষা, প্রকৃতির নিবিড় হওয়া সব মিলিয়ে দিনটা ছিল অনন্য। এ ভ্রমণ স্মৃতির পাতায় অমর থাকবে।