এস এম তাজাম্মুল,মনিরামপুর : প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা সমাগত। বাঙ্গালীর শীতের দিনের অন্যতম আকর্ষণ খেজুর গুড়ের তৈরি পিঠা-পায়েস। প্রাচীন কাল থেকেই অবিভক্ত খেজুর গুড়ের জন্য যশোর জেলা বিখ্যাত।এ সু-খ্যাতির পক্ষে একটি প্রবাদও প্রচলিত আছে (যশোরের যশ, খেজুরের রস) দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে যশোরের জীবনযাত্রায় অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলে যায়নি খেজুর রস সংগ্রহ এবং গুড়-পাটালি তৈরির পদ্ধতি।
তাই শীতের আগমনী বার্তা জানান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনিরামপুরের ‘গাছিরা’ প্রস্তুতি নিচ্ছে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের। এজন্য প্রথমেই খেজুর গাছ কেটে পরিস্কার করছেন তারা। তারপর শুরু হবে রস সংগ্রহ। চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতে মাটির ভাঁড়ে (কলসি) রাতভর রস সংগ্রহ করা হবে। কাক ডাকা ভোরের সূর্য ওঠার আগেই তা আবার গাছ থেকে নামিয়ে আনবে তারা।
পরে এই রস মাটির হাঁড়িতে কিংবা টিনের তৈরি কড়াইয়ে জ্বালিয়ে তৈরি করা হবে গুড়-পাটালি। যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা গুলোতে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে গুড়-পাটালি তৈরির সেই প্রক্রিয়া। গাছিরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে, অল্পদিনের মধ্যেই বাজারে পাওয়া যাবে নতুন খেজুর গুড়। গ্রামে গ্রামে পড়ে যাবে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা, পায়েসসহ নানা মুখরোচক খাবার তৈরির ধুম।
যশোরের ঐতিহ্যবাহী গুড়-পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বৃটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকেই তৈরি হতো চিনি। এ চিনি ‘ব্রাউন সুগার’ নামে পরিচিত ছিল। এই চিনি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো। বিলেত থেকে সাহেবেরা দলে দলে যশোর অঞ্চলে এসে চিনির কারখানা স্থাপন করে চিনির ব্যবসায় নামেন। চিনির কারখানাগুলো চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুর শহরের আশেপাশে কেন্দ্রীভুত ছিল।
যশোরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুরের আশেপাশে প্রায় পাঁচশ চিনি কারখানা গড়ে উঠেছিল। তখন কলকাতা বন্দর দিয়ে খেজুর গুড় থেকে উৎপাদিত চিনি রপ্তানি করা হতো। ১৮৯০ সালের দিকে আখ থেকে সাদা চিনি উৎপাদন শুরু হলে খেজুর গুড় থেকে চিনির উৎপাদনে ধস নামে। একে একে কারখানা গুলোও বন্ধ হয়ে যায়। খেজুরের গুড় থেকে চিনি তৈরি না হলেও এখন পর্যন্ত বাঙ্গালির কাছে খেজুর গুড়-পাটালির কদর কমেনি।
তবে বিজ্ঞানের এই যুগে এখনো রস থেকে গুড়-পাটালি তৈরিতে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। গুড়-পাটালি তৈরিতে আধুনিকতা আনা গেলে এটিও রপ্তানি পণ্যের তালিকায় স্থান পেত। মনিরামপুর উপজেলার কাশিমনগর, রোহিতা, ভোজগাতী, ঢাকুরিয়া, খেদাপাড়া, চালুয়াহাটি ও শ্যামকুড় ইউনিয়নে ঘুরে দেখা যায়, গাছিরা গাছ পরিস্কার ও রস জ্বাল করার জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
উপজেলা ঘুরে কথা হয়ে জয়পুর গ্রামের গাছি কাসেম মোড়ের সাথে,তিনি বলেন, প্রায় বেঁশীর ভাগ এলাকায় খেজুর গাছ নেই বললেই চলে ইট-ভাটার কারণে খেজুর গাছ আজ ধ্বংসের মুখে। তবে কিছু কিছু অঞ্চালে এখনো খেজুর গাছ রয়েছে সেগুলো পরিষ্কারে ব্যাস্ত সময় পার করছি এবং গাছ কাটা, রস জ্বালান ও গুড়-পাটালি তৈরীর উপকরণের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার গত বছরের তুলনায় গুড়-পাটালির দাম দ্বিগুন হবে বলে মনে করছি।
একই গ্রামের ওসমান মোল্লা বলেন, মাঠে-ঘাটে খেজুর গাছ এমনিতে বেঁড়ে উঠে তাই এই গাছের পেছনে তেমন খরচ ও শ্রম ব্যায় করতে হয়না। ইট-ভাটায় জ্বালানির কাজে খেজুর গাছ গুলো ব্যবহার করায় আগের তুলনায় এই গাছের সংখ্যা অনেক কম। সরকারিভাবে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ না করলে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ হয়তবা আরব্য উপন্যাসের গল্পই হয়ে থাকবে বলে জানান তিনি।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।