রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়েছে। বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) দিবসটি উপলক্ষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনসহ অন্যান্য ভবনে অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

পরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকে সকাল ৮টায় এবং সকাল সাড়ে আটটায় শহীদ মিনার ও বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে সকাল সোয়া নয়টায় স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে স্তিমিত করা। তাই ইয়াহিয়া খান এই যজ্ঞ পরিচালনার জন্য বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীকে এখানে পাঠিয়েছিলেন। তারা পরিকল্পিতভাবে বাঙালিকে মেধাশূন্য করতে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তখন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা দেশ। বিশ্বের কোথাও এমন হত্যার নজির নাই।

উপাচার্য আরও বলেন, এই হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছিল পাক হানাদারদের এদেশি দোসররা। এই রাজাকার ও আলবদরেরা খুঁজে খুঁঁজে এই বুদ্ধিজীবীদেরকে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও বাঙালি দমে যায়নি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে, রক্ত ও জীবন দিয়ে এই দেশ মুক্ত করেছিল। প্রসঙ্গক্রমে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক হানাদারদের বর্বরোচিত হামলা ও হত্যার নির্মম চিত্র তুলে ধরে স্মৃতিচারণ করেন।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী মীর আব্দুল কাইয়ূমের স্ত্রী অধ্যাপক মাসতুরা খানম বলেন, ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের দুইশ বছরের শাসন-শোষণের বেড়াজাল ভেঙে দুটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান শাসনামলে সেই একই শোষণ-বঞ্চনার শিকার হতে থাকলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। দীর্ঘ ২৪ বছর এই শোষণের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েছে বাঙালি জাতি। ১৯৭১ সালে এই অত্যাচার-নির্যাতন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তানী শাসকেরা পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাশূণ্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। কেননা তারা বুঝতে পেরেছিল এ দেশ স্বাধীন হবেই। তাই বাঙালি যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্যই পরিকল্পিত এই হত্যাযজ্ঞ ঘটায়।

অধ্যাপক মাসতুরা খানম আরও বলেন, হানাদার বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ক্যাম্পাসের জোহা হলের বন্দিশালায় ধরে নিয়ে আসা মানুষের উপর নির্যাতন চলতো। এছাড়াও মন্নুজান হল, পশ্চিমপাড়ার ১৭ নম্বর কোয়াটার, জুবেরী ভবনে তারা নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলে। যেখান থেকে প্রতিরাতে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন ও কান্নার আওয়াজ ভেসে আসত। ফলে সাধারণ মানুষ ভয়ে সেদিকে যেত না। এসব নির্মমতা শুধু হানাদারের হাতে হয়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতেও হয়েছে। পাকিস্তানের দোসরেরা বাঙালির স্বাধীনতার পথ চিরতরে বন্ধ করতেই এসব নির্মম কর্মকাণ্ড চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী কণ্ঠগুলো স্তব্ধ করতেই তারা এই ক্যাম্পাসে নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংস তাণ্ডব চালিয়েছিল। এই বর্বরতায় আমি স্বামীকে হারিয়েছি, কিন্তু এটা কষ্টের চেয়ে বেশি গর্বের। তাই বুদ্ধিজীবীদের চেতনা ও আদর্শ সবাইকে লালন করার আহ্বান জানান তিনি।

সভায় সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম। সভাপতিত্ব করেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবির। অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক অবায়দুর রহমান প্রামানিক, প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক, ছাত্র উপদেষ্টা এম তারেক নূর, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডে, বিভিন্ন অনুষদের অধিকর্তা, ইনস্টিটিউট পরিচালক, বিভাগের সভাপতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বুদ্ধিজীবী দিবসের আরও কর্মসূচিতে বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বিশেষ মোনাজাত ও সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।