রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ভয়ঙ্কর গাংচিল বাহিনীর প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ ওরফে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশারফ এবং তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। মোশারফ ও তার বাহিনীর অত্যাচারে মোহাম্মদপুর ও তার আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ ছিল বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা।

সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি জানান, রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে লম্বু মোশারফ এবং তার সহযোগী মো. বিল্লাল ওরফে চোরা বিল্লাল, মো. মোহন ওরফে বাইকে মোহন, সাহাবুদ্দিন সাবু, মো. রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল ও মো. সুমন মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় ১টি বিদেশি পিস্তল, ম্যাগজিন, ৪ রাউন্ড গুলি, ৩টি বড় ছোরা, ২টি চাপাতি, ২টি চাকু, ১টি চাইনিজ কুড়াল, ১টি দা, ১ টি হেসকো ব্লেড, ১টি গ্রিল কাটার, ১টি কাটার প্লাস, ৪২৩ পিস ইয়াবা, ৫টি মোবাইল ফোন এবং নগদ অর্থ জব্দ করা হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী আমিনবাজার, তুরাগ, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালাতো। তাদের দলে সদস্য ২৫-৩০ জন। লম্বু মোশারফ এ দলের নেতা। তার নির্দেশে সহযোগীরা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালুভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্যান্য নৌযান আটক করে চাঁদাবাজি করত। এছাড়াও তারা সাভার ও তুরাগ এলাকার বিভিন্ন ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করত। তারা মোহাম্মদপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে নির্মাণাধীন ভবনের মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজি করত। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে লম্বু মোশারফের বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভয় দেখাতো। চাঁদা না পেলে রাতের আঁধারে নিরাপত্তাকর্মীকে মারধর করে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে যেতো। জমি দখল, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য তারা দেশি-বিদেশি অস্ত্র ব্যবহার করত।

গাংচিল বাহিনী রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য এক আতঙ্কের নাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের এ অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে তারা বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করত। এছাড়াও, মোহাম্মদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে আধিপত্য বজায় রাখাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লম্বু মোশারফ গ্রুপের সদস্যরা একাধিক কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করত। তারা অধিকাংশ সময় নদীর কাছে আস্তানা গড়ে তুলত এবং নদীপথে ডাবল ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে যাতায়াত করত। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র, অপহরণ, পুলিশের ওপর হামলাসহ অভিযোগে মামলা আছে।

মোশারফ ভোলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। ১৯৯০ সালে জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় আসে সে। প্রথমে সে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। পরে সে আবাসন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ২০০০ সালে রাজধানীর কাফরুল থানার এলাকায় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে মোশারফ। পরবর্তী সময়ে গাংচিল বাহিনীর প্রধান আনারের মাধ্যমে ওই বাহিনীতে প্রবেশ করে এবং পর্যায়ক্রমে সে আনারের অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হয়। ২০১৭ সালে আনারের মৃত্যুর পর গাংচিল বাহিনী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়। এর মধ্যে মূল অংশের নেতৃত্ব দিতো তৎকালীন সেকেন্ড ইন কমান্ড লম্বু মোশারফ।

মোশারফ অনেক লম্বা হওয়ায় সে ‘লম্বু মোশারফ’ এবং মারামারির সময় প্রতিপক্ষের গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে ‘গলাকাটা মোশারফ’ হিসেবে পরিচিত।

মো. বিল্লাল ২০০৬ সালে মুন্সীগঞ্জ থেকে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসে। ঢাকায় সে প্রথমে পোশাক কারখানায় চাকরি ও গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করে। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময় লম্বু মোশারফের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত হয়। চুরিতে পারদর্শী হওয়ার কারণে সে ‘চোরা বিল্লাল’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

মোহন লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী। সে ২০১০ সালে ভোলা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসবাস শুরু করে। সে বিভিন্ন সময়ে পোশাক কারখানায় চাকরি করত। ২০১৮ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে কোম্পানিতে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেয়। সে লম্বু মোশারফের বাইক চালাতো বলে সে বাইক মোহন হিসেবে পরিচিত।