ধীরে লয়ে বয়ে যায় অযুথ ভৈরব। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে একথা পরিপূর্নভাবে সত্য ছিল। যারা নীলাকাশের নীচে প্রকৃত মনুষ্য জীব হয়ে যশোর জেলা নামক অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন বা করতেন, তারা তাদের অনেকেই চাক্ষুষ প্রমাণ হয়ে কালের সাক্ষী স্বরূপ এখনও দাড়িয়ে আছেন।

মোহাম্মদপুর নগরের হরিনাথ থেকে শুরু করে হরিনাকুন্ডুর কাঙ্গাল হরিনাথ সকলেই বটবৃক্ষের মত ছায়া-মায়া পেয়েছে এই ভৈরবের তীরে। যেমন শীলা রায় চৌধুরীর বিরামপুরের অবিরাম আশ্রায়ন বর্তমানে ছোট বাচ্চাদের স্কুল রূপে এবং তেমনি কিছুটা বেদখলদারদের দখলে চলমান আমাদের এই ভৈরব নদ।

 

প্রমত্তা বা কীর্তিনাশা নয়, সুফলা ভৈরব খেজুর গাছের বর্ধনকে ফেমাস করেই খ্যান্ত দেয়নি, কই মাছকেও ফেমাস করেছে। ভৈরব একটি নদীর নাম শুধু নয়, একটি সং¯ৃ‹তি সভ্যতার ইতিহাসও, একটি জ্বলন্ত অঙ্গার, মাতাময়ী দুর্গা আবার কখনো শিব। ভৈরব কখনো মরা ভৈরব,

কখনো বুড়ি ভৈরব নামে যশোর জেলার মধ্যে সাপের মতন আঁকাবাকা পথ ধরে খুলনা হয়ে পশুর নদীর সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে “হারিয়ে” গিয়েছে। ’হারিয়ে যাওয়া’অর্থটা এখানে আসলেই মিশে যাওয়া নয়, হারিয়ে যাওয়াই বুঝানো হয়েছে। কারণ বর্তমানে যশোরের অভয়নগর থানার নওয়াপাড়ার আগ পর্যন্ত যে ভৈরব, তাঁর কোনো মহাপুরুষের মতন শৌর্য-বীর্য নেই।

খাঁন জাহান আলীর সময় বারোবাজার অঞ্চল এবং হামিদপুরের বালুর ঘাট, বালিয়াডাঙ্গা, ইত্যাদি সব ভৈরবের জলে থৈ থৈ করত এবং বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ, স্টীমার চলাচল করত। কথিত আছে, বড়পীর খাঁন জাহান আলী (রঃ) একবার নামাযরত অবস্থায় ছিলেন আর তখন প্রচন্ড বন্যায় সব ভেসে যাচ্ছিল।

 

পীর সাহেব নামায পড়ছিলেন ভৈরব নদীর তীরে, তিনিও ভেসে যাওয়ার উপক্রম হতেই, তিনি তার লাঠি দিয়ে পানিতে বাড়ি মারলেন, তৎক্ষনাৎ আকস্মাৎ সব থেমে গেল কিন্তু বড়ো বাঁধ তৈরী হয়ে গেল ভৈরব নদীতে। সেই বাঁধ নাকি বর্তমানের নওয়াপাড়ার কাছাকাছি।

লোকায়ত এই কাহিনীর পাশাপাশি আরেক কাহিনী হলো মাছ ব্যবসায়িরা তৈরী করে এই বাঁধ। বর্তমানে নওয়াপাড়া থেকে খুলনার দিকে ভৈরবে এখনও বড় বড় কয়লা ও পাথর বহনকারী লঞ্চ, স্টীমার চলাচল করে নিয়মিত কিন্তু নওয়াপাড়ার এপাশে যশোরের দিকের ভৈরব নদী শুকিয়ে যেতে যেতে ক্ষীনকায় লতার আকার ধারন করেছে।

 

যদিও এর পেছনে শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই দায়ী, তাই নয়, মনে করা হয়, মানুষের দখল ও মাছ চাষ নামক অবৈধ লিজিং সহ বহু লোভ-লালসার, কামনা-বাসনার করাল গ্রাসে আজ মৃতপ্রায় শান্ত পানির ভৈরব নদ। যদিও খুলনা নগরীর অবস্থান বলতে ভৈরব নদীকে ব্যবহার করা হয় কিন্তু সেটা শেষের অংশ আর প্রকৃত ভৈরবের উৎপত্তি কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর উপশাখা

নদী গড়াইয়ের উপনদী নবগঙ্গা যেটা মাগুরাকে ঘিরে বয়ে চলেছে তারই হাত ধরে যশোরে পদার্পণ করেছে। তাই বলা যায় ভৈরবের প্রকৃত অবস্থান যশোর। ভৈরব যশোরের নদী। আমরা যশোরের মানচিত্রে নদীর অবস্থান দেখলে দেখবো যশোরকে চতুর্দিক দিয়ে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরে আছে।

 

যদিও সবাই যশোর বলতে বোঝে কপোতাক্ষ নদের কথা। কিন্তু কপোতাক্ষ নদ এক দিকের একটি অংশ মাত্র, যেমন মানুষের ডানহাত মানে পুরো মানুষ নয়, তেমনই কপোতাক্ষ মানে যশোর নয়, কিন্তু ভৈরব হলো হৃদয়, যশোরের প্রতিটি উপজেলায় যার সদা পদচারনা বর্তমান (পূর্বে আরো ভালো স্বাস্থ্যবান ছিল)।

মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত ‘কপোতাক্ষ নদ’ নামক বিখ্যাত সনেট রচনা করার কারণে, আজ সারা বিশ্বে যশোর কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত বলে সুপরিচিত। বাংলাদেশের সমস্ত নদীই উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত।

ইতিহাস:
ভৈরব নদ বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাংশের একটি নদ। ভৈরব নদের তীরে খুলনা ও যশোর শহর অবস্থিত। এছাড়া এর তীরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ন শহর গুলোর মধ্যে রয়েছে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, বড় বাজার (বারোবাজার), কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, দৌলতপুর ও বাগেরহাট। হিন্দুদের কাছে নদীটি পবিত্র হিসেবে সমাদৃত।

নদীটির নাম ‘ভৈরব’ এর অর্থ ভয়াবহ। এক সময় গঙ্গা/পদ্মা নদীর মূল প্রবাহ এই নদকে প্রমত্তা রূপ দিয়েছিল, সেই থেকেই নামটির উৎপত্তি। নদটির দুইটি শাখা রয়েছে ইছামতি নদী এবং কপোতাক্ষ নদ। খুলনা-ইছামতির কিছু অংশ ভারতে এবং বাকীটুকু বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় পড়েছে-এই নদীটি সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা নির্দেশ করে।

 

ভৈরব নদীটি তার যাত্রাপথে একেক স্থানে একেক নাম নিয়েছে। কালীগঞ্জ হতে কৈখালী পর্যন্ত নদীটির নাম ‘কালিন্দি’। এর পর এটি ‘রায়মঙ্গল’ নামে পরিচিত। তারপর নদীটি দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিমের অংশটি ‘হাড়িভাঙ্গা’ এবং পূর্বেরটি ‘ভৈরব’ নামে প্রবাহিত হয়।

কৈখালীর পর নদীটি ‘খুলনা-ইছামতি’ নামে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণের অংশটি ‘রায়মঙ্গল হাড়িভাঙ্গা নামে পরিচিত। ভৈরব নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার। বর্তমানে নদটির অনেকাংশ শুকিয়ে গিয়েছে। যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলা পার হলে নদীটির আর নাব্য থাকে না।

 

বর্ষা মৌসুমে এটি নাব্য থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নদীটি শুকিয়ে যায়। তবে নদটির নিচের দিকের অংশে জোয়ার ভাটা হয় ও তা সারা বছর নাব্য থাকে। যশোরের অন্যান্য নদী হলো Ñ চিত্রা, কপোতাক্ষ, চেতনা, যুক্তেশ্বরী (বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ খন্ড-৪, প্রধান সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, লেখক,

মোহা. শামসুল আলম এবং মাসুদ হাসান চৌধুরী, পৃ. ৪৮৩-৮৬, ২০১৪, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি,ঢাকা)। যশোরের অন্যান্য নদী হলো: আপার ভৈরব, লোয়ার ভৈরব, চিত্রা, বেগতী, নবগঙ্গা, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বারাসিয়া, খোলপটুয়া, এলেংখালি, পানগুবি, করা,

কালীগঙ্গা, কাঠিপোতা, দড়াটানার খাল, মরিছাপ, চাঁদখোনি, পাংগানি, নাইনগত সমুদ্র, বড় পাঙ্গা, কুমার, বড় গাংদিয়াদহ, আমলা মদরপুর, ডাকোয়া, মরাগড়াই, পালং, আত্রাই প্রভৃতি।