‘জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ’। উভয় সঙ্কটে পড়া এমন প্রবাদের সঙ্গে যেন হুবহু মিল পাওয়া যায় ‘বিশেষ আনসার’ সদস্যদের জীবন-জীবনীতে। একদিকে খুবই স্বল্প বেতনে ‘অস্থায়ী’ চাকরি করে মানবেতর জীবনযাপন, অন্যদিকে চাকরি ছেড়ে চলে গেলে হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা। চাকরি স্থায়ীকরণে প্রতিশ্রুতির মাঝেও এমন উভয় সঙ্কটে কেটে গেছে প্রায় ২২ বছর।

তবে এবার যেন কষ্টের দিন শেষ হচ্ছে। সেই বিশেষ আনসার সদস্যদের জন্য এখন সুদিনের পালা। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন পর চাকরি স্থায়ীকরণের জটলা খুলে যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের ‘হিল আনসারদেরও’। দীর্ঘদিন পর চাকরি স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি বাহিনীর আনুষঙ্গিক সব সুবিধা পেতে যাচ্ছেন তারা।

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়ে সর্বশেষ গত বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও বিশেষ আনসার ও হিল আনসারদের চাকরি আনসার বাহিনীতে অঙ্গীভূতকরণের মাধ্যমে স্থায়ীকরণে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখা-৫-এর সিনিয়র সহকারী সচিব চৌধুরী আশরাফুল করিম স্বাক্ষরিত একটি সম্মতিপত্রে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ৬০০ জন হিল আনসার এবং ৪৩৯ জন বিশেষ আনসারের চাকরি স্থায়ীকরণ/নিয়মিতকরণে সম্মতি জানিয়ে ১০টি শর্ত পূরণের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও ওইসব শর্তাবলী মূলত বিভাগীয় পর্যায়ে পূরণ করতে হবে। এসব শর্তাবলী যত দ্রুত পূরণ করা হবে ততই দ্রুত সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন দীর্ঘদিনের জটিলতায় থাকা ওই মোট ১ হাজার ৩৯ জন আনসার সদস্য।

বর্তমানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় কর্মরত আছেন বিশেষ আনসার সদস্য আবদুল আলিম। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ সদর থানার কাঞ্চনপুরে। সময়ের আলোকে তিনি গতকাল বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের অপেক্ষায় আছি। বর্তমানে দিনভিত্তিক যা বেতন পাই তাতে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে আমাদের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে দীর্ঘদিন পর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও চাকরি স্থায়ীকরণের অনুমোদনের কারণে এখন কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। এটা যাতে দ্রুত বাস্তবায়িত হয় সেটাই এখন কামনা করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি যেন দ্রুত বাস্তবায়ন হয়।’

 

খুলনার তেরোখাদা থানার আনন্দনগরের বাসিন্দা জাকির হোসেন বর্তমানে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় বিশেষ আনসার হিসেবে কর্মরত। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। খুব কষ্টে আছি আমরা। এখন কিছুই বলার নেই, শুধু বলবÑ যত দ্রুত সম্ভব আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হোক।’

বিশেষ আনসার ও হিল আনসার সদস্যরা বর্তমানে অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৩ হাজারের কিছু বেশি টাকা বেতন-ভাতা পান। একটি বাহিনীর সদস্য হলেও চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় রেশন সুবিধা ও ঝুঁকিভাতাসহ আনুষঙ্গিক প্রায় অনেক সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত। তবে চাকরি স্থায়ী হলেই তারা সর্বসাকুল্যে ২৩ হাজার ৫০০ টাকা হারে বেতন-ভাতা পাবেন। এ ছাড়াও রেশনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও পাবেন তারা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, হিল আনসার ও বিশেষ আনসার হিসেবে চাকরিকালের ৫০ শতাংশ ব্যাটালিয়ন আনসার হিসেবে চাকরিকাল গণনা হবে। বিশেষ আনসার ও হিল আনসারদের চাকরি স্থায়ীকরণের মাধ্যমে তাদের ব্যাটালিয়ন আনসারে শূন্যপদে নিযুক্ত করা হবে।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর জনসংযোগ শাখার দায়িত্বে থাকা সহকারী পরিচালক জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংশ্লিষ্ট দফতরে খোঁজখবর নিয়ে তারপর ‘অফিসিয়ালি’ বলতে পারবেন বলে জানান। যদিও সময়ের আলোর কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশের কপি সংরক্ষিত আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, এমএল লাল পতাকা, এমএল জনযুদ্ধসহ বিভিন্ন নামে চরমপন্থি সর্বহারা দলের ব্যাপক তৎপরতা ও উৎপাত ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পুলিশ ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। কঠোর অভিযান শুরু হলে চরমপন্থিদের অনেকেই সন্ত্রাসী জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোনো পথ পাচ্ছিলেন না। দল ছাড়লে নিজেদের লোকদের হাতে খুন, আবার প্রকাশ্যে এলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা- সব মিলিয়ে উভয় সঙ্কটের সৃষ্টি হয়।

এরই মধ্যে ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ঘোষণা দিয়েছিলেন, চরমপন্থিদের দলের যারা আত্মসমর্পণ করবেন তারা সাধারণ ক্ষমার সুযোগ পাবেন এবং তাদের পুনর্বাসন করা হবে। তখন চরমপন্থি বিভিন্ন গ্রুপের ২ হাজার ১২৬ সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না তাদের মধ্য থেকে ৭৬৫ জনকে আনসার বাহিনীতে ‘বিশেষ আনসার’ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পুনর্বাসনের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে বেশ কিছু সদস্য চাকরিচ্যুত হন আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে ৪০০ বিশেষ আনসার সদস্য দেশের অন্তত ৩৫টি জেলায় পুলিশের সঙ্গে কর্মরত রয়েছেন।

এ ছাড়া আশির দশকের মাঝামাঝিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সন্ত্রাসীদের ব্যাপক আগ্রাসন দেখা দিলে অভিযানে সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য সেই প্রেক্ষাপটে সেখানেও হিল আনসার হিসেবে অনেকে আনসার বাহিনীতে নিয়োগ পান। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তারাও চাকরিতে স্থায়ী না হওয়ায় বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। বর্তমানে কর্তব্যরত হিল আনসার সদস্যের সংখ্যা ৬০০। তারা মূলত পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতেই বেশি কর্মরত।