সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপকূলীয় মানুষ সিডর, আম্পান, যশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। জোয়ারের পানির তোড়ের সময়-অসময় বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে যায় বাড়ি ঘর ফসল ও মাছের ঘের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে এই এলাকার মানুষের একটাই দাবি ‘টেকসই বেড়িবাঁধ’।
এলাকাবাসী বলছেন, বেড়িবাঁধ রক্ষার জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সরকার। অথচ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে টেকসই বাঁধ আর হচ্ছে না। এ সময়ে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ চলছে। দেখা গেছে, স্কেবেটর মেশিন দিয়ে বাঁধের কাছ থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। বাঁধের পাশের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বাঁধ ছিদ্র করে ঘেরে পানি ওঠানোর জন্য পাইপ দিয়েছে। তিন ফুট মাটি দেওয়ার কথা থাকলেও এক থেকে দেড় ফুট মাটি দেওয়া হচ্ছে। আগামি বর্ষা মৌসুমের আগেই এই বাঁধ ধসে যাবে, বলছেন এলাকাবাসী। জানা যায়, নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে শ্যামনগর পওর উপ
-বিভাগে কর্মরত একজন অফিস সহকারী ও বিভিন্ন লেবার সরদাররা এই বাঁধ সংস্কারের কাজ করছেন। যে কারণে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের টুঙ্গীপাড়া-পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকায় বেড়িবাঁধ সংস্কারে হচ্ছে ব্যাপক অনিয়ম। স্থানীয়রা জানান, উপকুলীয় এলাকার দুর্যোগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বর্ধিতকরণ প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর আওতাধীন ৫নং পোল্ডারে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে ৪ দশমিক ৯০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ জিও ব্যাগ দিয়ে সংস্কারের জন্য ৪ কোটি ১২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কুষ্টিয়ার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সি এ্যাসোসিয়েট মোট ৩ কোটি ৪৯ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকার চুক্তি মূল্যে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ভামিয়া স্লুইস গেট হতে পশ্চিম দূর্গাবাটি পর্যন্ত কিলোমিটার ১০৫.৭০০ হতে ১১০.৫৭০ পর্যন্ত তিনটি চেইনেজে ভাগ করে উক্ত বাঁধ সংস্কার কাজ দরপত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। কাজের মধ্যে মাটি দিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার ও জিও ব্যাগ প্লেসিং ও ডাম্পিং রয়েছে।
কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সি অ্যাসোসিয়েট নিজেরা কাজ না করে সাব কন্ট্রাক্ট দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানের ২.৩২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৯৩০ মিটার বাঁধের সংস্কার কাজের সাব কন্ট্রাক্ট নিয়েছেন শ্যামনগর পওর উপ-বিভাগে কর্মরত অফিস সহকারী মো. খোরশেদ আলম ও কয়েকজন লেবার সরদার। তার এই অংশের সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। দরপত্র অনুযায়ি বেড়িবাঁধের নদীর পাশে ২৪ ফুট, ভূমির পাশে ১৪ ফুট, বাঁধের উপরে (মাথা) প্রশস্ত ১৪ ফুট এবং উচ্চতা পুরাতন বাঁধ থেকে ৩ ফুট হওয়ার কথা। কিন্তু দরপত্র অনুযায়ি তারা কাজ করছেন না। অধিকাংশ স্থানে বাঁধের উচ্চতা এক থেকে দেড় ফুটের বেশি হচ্ছে না।
বাঁধের মাথা ও দুই পাশের অনেক কম হচ্ছে। এছাড়া স্কেবেটর মেশিন দিয়ে বাঁধের কাছ থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। যে কারনে তার সংষ্কার করা বাঁধ ইতোমধ্যে অনেক স্থানে ধ্বসে পড়েছে। স্থানীয়দের আরো অভিযোগ, প্লেসিং ও ডাম্পিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা জিও ব্যাগে বালুর পরিমান কম দেওয়া হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ি ডাম্পিংয়ের ব্যাগে ২২০ কেজি ও প্লেসিংয়ের ব্যাগে ১৭৫ থেকে ১৮০ কেজি বালু ভরার কথা থাকলে অধিকাংশ জিও ব্যাগে বালুর পরিমান কম দেওয়া হচ্ছে। ফলে নতুন সংস্কার করা বেড়িবাঁধ থেকে যাচ্ছে ঝুঁকির মধ্যে। পাউবো অফিসের স্টাফ হওয়ায় খোরশেদ আলম অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তিনি বাঁধ সংস্কারের কাজে এই অনিয়ম করে চলেছেন। বুড়িগোয়ালিনী পূর্ব দূর্গাবাটি গ্রামের বাপি মন্ডল জানান, প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে আছি আমরা। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস হলেই দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। সরকার প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণে বাঁধ সঠিকভাবে মেরামত করা হয়না। এখনো তাই হচ্ছে।
যা আমাদের ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে রেখেছে। একই অভিযোগ করেন ওই এলাকার আহছানুর রহমান, লুৎফর রহমান মোল্যা, বিকাশ মন্ডল, খালেক সরদার ও কালিপদ মন্ডল। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল জানান, এ ইউনিয়নে অধিকাংশ বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড যেনতেনভাবে এসব বাঁধ সংস্কারের কাজ করে থাকে বলে প্রায় প্রতিবছর বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের জানান, সাব কন্ট্রাক্ট দিয়ে বেড়িবাঁধের কাজ করানো যাবে না।
বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সি অ্যাসোসিয়েট কাজ এখনো বুঝিয়ে দেয়নি, কাজ চলমান রয়েছে। বৃষ্টির কারণে কাজে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমরা সরেজমিনে কাজ দেখে নিবো। তবে শ্যামনগর পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পওর) উপ-বিভাগে কর্মরত অফিস সহকারী মো. খোরশেদ আলম সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।