সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা বলে কথা। ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, আবার কাজের জন্য অলিখিত কমিশন। আছে বদলি বাণিজ্যসহ ঘাটে ঘাটে রমরমা ঘুসের বাজার। এসব অবৈধ টাকায় অনেকটা ফুলেফেঁপে উঠেছেন তিনি।

আবার একাই মোটাতাজা হননি, ভাই-ভগ্নিপতিসহ শ্বশুরবাড়ির সদস্যদেরও বিপুল বিত্তশালী বানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সন্তানের যখন আয়-রোজগার করার বয়সই হয়নি, তখন তার নামে খুলেছেন আয়কর ফাইল। যেখানে ছেলের নামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দেখানো হয় বিপুল বিনিয়োগ। এভাবে জায়েজ করা হয় ঘুসের কোটি কোটি টাকা।

এতেও সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা ছোট ভাইয়ের নামে দেওয়া হয় ঠিকাদারি লাইসেন্স। যদিও বাস্তবে ঠিকাদারি কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। তবে এ সুবাদে তার প্রধান কাজ এখন বড় বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া এবং বিনিময়ে কাঁড়ি কাঁড়ি কমিশন আদায় করা। আর এসব অবৈধ টাকা জায়েজ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হিসাবে কাগুজে ডকুমেন্ট তৈরি করে রাখা। এভাবে নানা খাতের ঘুস বাণিজ্যের টাকা নিরাপদে লেনদেনের জন্য ছোট ভাইয়ের ঠিকাদারি অ্যাকাউন্টকে ব্যবহার করা হয়। ফলে ব্যাংক হিসাবে শুরু হয় অস্বাভাবিক সব লেনদেন। প্রকারান্তরে এভাবেই নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেন। সরকারের একটি সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে থাকে কেঁচো খুঁড়তে বড় বড় সাপ। কম সময়ের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকার সব লেনদেনের ভয়াবহ তথ্য। যার সঙ্গে বাস্তব আয় ও ব্যবসায়িক লেনদেনের কোনো মিল নেই।

কারণ এই বিপুল অর্থকড়ির আসল হোতা প্রকৌশলী বড় ভাই। সবই তার ঘুসের টাকা। ক্ষমতাধর ও সৌভাগ্যবান এ কর্মকর্তার নাম একেএম মনির হোসেন পাঠান। তিনি সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলী। যার আপন ছোট ভাই কথিত ঠিকাদার। নাম মোমিনুল হক পাঠান।  ২ মাসের অনুসন্ধানে এই কর্মকর্তাসহ তার পুরো পরিবারের আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদের চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

ভাইয়ের নামে যেভাবে টাকা লেনদেন : ২০২২ সালের ২৪ মার্চ মধুমতি ব্যাংক নওগাঁ ব্রাঞ্চ থেকে মনির হোসেন পাঠানের ছোট ভাই মোমিনুল হক পাঠানের এনআরবিসি ব্যাংক চাঁদপুরের মতলব ব্রাঞ্চে এক কোটি ৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫শ টাকা জমা হয়। ৩ দিনের মধ্যেই এই টাকা আবার উত্তোলন করে সরিয়ে ফেলা হয়। একই ব্রাঞ্চ থেকে ২০ এপ্রিল ৬৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা জমা হওয়ার পরপরই এই টাকা তুলে নেওয়া হয়। আবার ২৮ এপ্রিল জমা হয় ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ৬শ টাকা, ২৩ মে ক্যাশ জমা করা হয় ১ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার, ২৬ মে মার্কেন্টাইল ব্যাংক নওগাঁ ব্রাঞ্চ থেকে ৩৪ লাখ ৯৪ হাজার ৬শ টাকা, ৫ জুন মধুমতি ব্যাংকের নওগাঁ ব্রাঞ্চ থেকে ৩৪ লাখ ৯৬ হাজার ৬শ টাকা, ১৩ জুন মার্কেন্টাইল ব্যাংক নওগাঁ ব্রাঞ্চ থেকে ৪১ লাখ ৫২ হাজার, ৭ জুলাই মার্কেন্টাইল ব্যাংক নওগাঁ ব্রাঞ্চ থেকে ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার ৬শ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬ মাসের ব্যবধানে সড়ক ও জনপথের প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেডের অ্যাকাউন্ট থেকে মোট ৬ কোটি ১১ লাখ ৯৭ হাজার ৯শ টাকা জমা হয়। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নওগাঁর আমিনুল হক। সওজের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘এ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সড়ক ও জনপথ।’

কুমিল্লায় কর্মরত সওজ’র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে আমাদের চিফ স্যার এখন শ্বশুরবাড়ির পরিবারের লোকজনের নামে সম্পদ কেনাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করছেন। এছাড়া কানাডায় স্যারের একজন মেয়ে আছে। সেখানেও বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি।’ তিনি মনে করেন, মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন নিরপেক্ষভাবে এসব বিষয়ে তদন্ত করলে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায় একেএম মনিরের আয়কর রিটার্নে। সেখানে ভাই শাহাদাত হোসেন ও স্ত্রীর বড় ভাই রইস আব্দুর রবের টিআইএন নম্বর উল্লেখ করে টাকা লেনদেনের তথ্য দেওয়া হয়। মূলত এভাবে তিনি তার আয়কর ফাইল ত্রুটিমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। যদিও তিনি আয়কর রিটার্নে কুমিল্লা কান্দিরপাড়ে অবস্থিত প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ গোপন করেছেন।

এদিকে ঘুস, দুর্নীতি ও বদলি বাণিজ্যের সব অভিযোগ অস্বীকার করেন একেএম মনির হোসেন পাঠান। তিনি দাবি করেন, ‘ছেলে তার মামার সঙ্গে ব্যবসা করে। এছাড়া আমার আয়কর রিটার্নের বাইরে কোনো সম্পদ নেই। মহল বিশেষ তার সুনাম নষ্ট করতে এসব অপপ্রচার করছে।’ প্রধান প্রকৌশলীর ছোট ভাই মোমিনুল হক পাঠানও ফোন রিসিভ করেননি। তাকেও বিস্তারিত জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো সদুত্তর দেননি।